গর্ভধারণের ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেওয়াকে প্রিম্যাচিউরড জন্ম বলা হয়। বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রায় একজন শিশুর জন্ম এভাবে হয়। বিশ্বে নির্ধারিত সময়ের আগে বা অপরিণত অবস্থায় শিশুর জন্মহারে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। এ দেশে প্রতি ঘণ্টায় তিনটি অপরিণত শিশুর জন্ম হচ্ছে। অন্যদিকে, কম ওজনের শিশু জন্মের দিক থেকেও বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বিশ্বখ্যাত সাময়িকী দ্য ল্যানসেটের তথ্যমতে, বাংলাদেশে অপরিণত শিশু জন্মের হার ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। সংখ্যার বিবেচনায় বছরে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৬০০ শিশু অপরিণত বা মাতৃগর্ভে ৩৬ সপ্তাহে থাকার পরই ভূমিষ্ঠ হচ্ছে। এতে শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বভাবতই। একই সঙ্গে অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেওয়া শিশুদের শারীরিক ও স্নায়বিক নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে।
সময়ের আগে অর্থাৎ ৪০ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে যে সব শিশুর জন্ম হয়, সেসব নবজাতকের শাসকষ্ট, জন্ডিস, রক্তস্বল্পতার ঝুঁকি থাকে। এসব নবজাতকের শরীরে তাপ মাত্র কম থাকে; রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কম থাকে। ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে বেশি। পাশাপাশি সেরিব্রাল পালসি, মৃগীরোগ বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিও থাকে, ঠিকমতো হয় না মানসিক বিকাশও। তবে জন্মের পর মায়ের ত্বকের সংস্পর্শে নবজাতককে রাখলে নবজাতকের মৃত্যু ২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব। গবেষকরা দেখেছেন, এ ধরনের নবজাতক মেয়ের চেয়ে ছেলেই বেশি। বিশ্বের অনেক দেশেই এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ নবজাতকের বিষয়ে অনেক কাজ হয়েছে; হয়েছে অনেক উদ্ভাবনও। এসব বিষয়ে জ্ঞান ও প্রযুক্তি বাংলাদেশেও আছে, কিন্তু প্রতিরোধ ও চিকিত্সায় এর পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। বিভিন্ন জরিপে জানা গেছে, বাংলাদেশে কম ওজন নিয়ে শিশু জন্মের হার ২৩ শতাংশ। স্বল্প ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা বছরে ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৭০০। এক্ষেত্রে ১৫৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়।

অপরিণত শিশু জন্ম বিভিন্ন কারণে হতে পারে। বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, ঘরের ভেতরের বায়ুদূষণও অপরিণত নবজাতকের জন্মের পেছনে কাজ করে। বিশেষ করে, গর্ভকালীন সময়ে কোনো ইনফেকশন, জরায়ু ছোট থাকলে বা জরায়ুতে কোনো টিউমার থাকলেও অপরিণত শিশু হতে পারে। মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের অস্বাভাবিকতা, কিডনির সমস্যা, গর্ভাবস্থায় যথেষ্ট ওজন বেড়ে যাওয়া, অত্যধিক ওষুধ সেবন করলে অপরিণত নবজাতকের জন্ম হতে পারে। তবে অনেক ক্ষেত্রে অপরিণত শিশু জন্মের কারণ থাকে না এটা উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দিতে হয়। অপরিণত শিশু জন্ম প্রতিরোধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে শিশু আকালিক হওয়ার কারণ জানা যায় না। তবে এসব শিশুকে এক সপ্তাহ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হলে পরবর্তী সময়ে ভালো ফল দেখা যায়। তবে জন্মের পর থেকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে নবজাতকের ঝুঁকি কমে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) মেটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ বিভাগের তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৭৪ শতাংশ প্রসব হাসপাতালে হয়। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে হয়তো ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ হয়ে যাবে। অর্থাত্ বেশির ভাগ শিশু গাইনোকলজিস্ট, পেডিয়াট্রিকস ও নিওনেটোলজিস্টদের কাছেই জন্মগ্রহণ করবে। অর্থাত্, প্রতি ঘণ্টায় জন্ম নেওয়া ৫৬টি শিশু চিকিত্সার আওতাধীন থাকবে। ফলে তাদের বাঁচা ও সুস্থ জীবন লাভের সুযোগ তৈরি হবে। এটা আশার আলো হলেও একটা দুঃখজনক বিষয় হলো, দেশে অপরিণত শিশু জন্মের প্রতিরোধ কার্যক্রমে গতি নেই। এখনো বছরে প্রায় ৫ লাখ অপরিণত শিশুর জন্ম হচ্ছে। এতে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।
তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত যথাযথ নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্র বাড়ানো তদারকি না থাকায় মূলত এমন অবস্থা। ফলে দেশে শিশুর মৃত্যুর ২২ শতাংশই ঘটছে অপরিণত ও কম ওজন নিয়ে জন্মানোর কারণে। ইনজেকশন দেওয়ার মাধ্যমে জটিলতার মৃত্যুও ঝুঁকি হ্রাস করা যায়। প্রসব-পূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী পর্যায়ে সেবা বা করণীয় সম্পর্কে জানা আছে কিন্তু কাজগুলো ঠিকভাবে হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তদারকি ও নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্তদের জবাবদিহি নিশ্চিত করাও জরুরি। চিকিৎসকদের বক্তব্য, এ ধরনের নবজাতকের চিকিত্সায় তিনটি ব্যবস্থা আছে। অ্যান্টিনেটাল কোরটিকোস্টেরয়েড (এসিএস), ক্যাঙারু মায়ের সেবা (কেএমসি) এবং নবজাতকের বিশেষ সেবা ইউনিট (স্কানু)। কিন্তু ৫ শতাংশের কম নবজাতক ক্যাঙারু মায়ের সেবা (কেএমসির) সুযোগ পায়। দেশে মাত্র ৬২টি হাসপাতালে বিশেষ সেবা ইউনিট ( স্ক্যানু) রয়েছে। নবজাতকের সেবার ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালগুলো অনেক পিছিয়ে। এ ছাড়া শিশুর জন্মের কিছুক্ষণ আগে স্টেরয়েড ঢাকা বাইরের অধিকাংশ চিকিত্সাকেন্দ্রে গর্ভাবস্থায় কম ওজন ও অপরিণত শিশু শনাক্তের ব্যবস্থা নেই। রয়েছে দক্ষ জনবলের অভাব। অনেক হাসপাতালে ডিজিটাল ওজন মাপার যন্ত্র নেই। বেসরকারি চিকিত্সাকেন্দ্রের অবস্থা আরো নাজুক। তারা কোনো তথ্য দিতে চায় না বলে অভিযোগ। যদিও বর্তমানে আমাদের দেশের নবদম্পতিরা অনেক সচেতন। গর্ভধারণের ব্যাপারে তারা হাসপাতালে পরামর্শ নিতে অসেন এখন। এটি একটি ভালো দিক।
সুতরাং বলা যায়, সঠিক প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করা গেলে হবু মায়েদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে, আর তাতে করে কমে আসবে অপরিণত শিশু জন্মের মৃত্যু ঝুঁকি।