একটি নাম, একটি ইতিহাস। ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত, এরপর আর একটি গুলি চললে, তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে’—উক্তিটি আজও চির ভাস্বর। ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর আইয়ুব খান সরকার হামলা চালালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে সন্ধ্যায় সবার সামনে ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত নিজের শার্ট দেখিয়ে ভয়ডরহীন কণ্ঠে এই কথাগুলো বলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর শহীদ ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। ঐদিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি এবং সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে ১৪৪ ধারা ভেঙে সকালে রাস্তায় নামেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা তখন প্রধান ফটকের কাছাকাছি। আন্দোলনের গতি বাড়তে থাকে। এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে পাকিস্তানি সেনারা মিছিলে গুলি করতে উদ্ধত হয়। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। দাঁড়ান ছাত্রদের সামনে; বলেন, ‘ডোন্ট ফায়ার, আই সেইড ডোন্ট ফায়ার! কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার বুকে গুলি লাগে।’

ছাত্রদের বাঁচাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন এভাবেই নিজের বলিষ্ঠ কন্ঠে ঝড় তুলেছিলেন ড. শামসুজ্জোহা। একপর্যায়ে ড. জোহা ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন; কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করে ১৮ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টার দিকে ক্যাপ্টেন হাদী পিস্তল বের করে ড. জোহাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিবিদ্ধ ড. জোহাকে পরে রাজশাহী মিউনিসিপল অফিসে নিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বলা বাহুল্য, ড. জোহার এই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সরকারের ভীত নড়বড়ে হয়ে যায়। তরান্বিত হয় বাঙালি জাতির জাগরণী চেতনা, যা বেগবান করেছিল দেশমাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিকে।
ড. জোহা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী তিনি। জোহা স্যারকে ‘শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধি’ বলা যায়। প্রতিটি শিক্ষক যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে এভাবে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে সমাজ সংস্কার নিঃসন্দেহে আরো বেশি সহজতর হত। তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা, বলিষ্ঠ, অকুতোভয় এবং দেশপ্রেমিক। ড. জোহা ছাত্রদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধসম্পন্ন শুধু একজন আদর্শ শিক্ষকই নন, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, শহীদ ড. জোহা স্যারের আত্মত্যাগের অর্ধশত বছর অতিবাহিত হতে চললেও এখন পর্যন্ত এ দিবসটিকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ২০০৮ সালে রাষ্ট্র তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে এবং তাঁর নামে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করার মধ্য দিয়েই দায় এড়িয়ে গেছে! এমনটা অপ্রত্যাশিত।
পৃথিবীর ইতিহাসে ছাত্রদের জন্য শিক্ষকের প্রাণ বিসর্জনের ঘটনা বিরল। উল্লেখ করতে হয়, বিশ্বের বিভিন্ন সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পরও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করাকেই শ্রেয়জ্ঞান করেছিলেন ড. জোহা। এমন একজন মানুষকে যদি আমরা ভুলে যাই, তা হবে সত্যিই অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক। বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন, তার রক্তের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ১৭ ফেব্রুয়ারিকে “জাতীয় শিক্ষক দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে। যদিও ২০০৩ সালে ১৯ জানুয়ারিকে তৎকালীন সরকার ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে বিশ্বের শিক্ষক সম্প্রদায়ের কথা চিন্তা করে ইউনেস্কো ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) কিছু পরামর্শে সই করে। এরই প্রেক্ষিতে বর্তমানে জাতীয় শিক্ষক দিবসের পরিবর্তে প্রতি বছরের ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হচ্ছে। এখানে আরও উল্লেখ্য, বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশ ‘স্বতন্ত্র শিক্ষক দিবস’ পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে ড. শামসুজ্জোহা স্যারের বিষয়টি আমরা স্মরণ করতে পারি। কারণ, তিনি শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা স্যার ছিলেন না, বরং তিনি সারা বাংলার শিক্ষক সম্প্রদায়ের গর্বের একটি জায়গা। জাতির জন্য আত্মদানকারী এই মহান শিক্ষকের আত্মত্যাগের দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করার নিমিত্তে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণার কথা চিন্তা করলে মন্দ হয়না। এতে করে জাতি ও বর্তমান প্রজন্ম এই মহান মানুষটি সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবে। একজন ড. জোহা স্যারকে আমরা যেন ভুলে না যাই। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে তার বীরত্ব অমর হয়ে থাকুক।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়