আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা এ দেশে নতুন কিছু নয়। ঘটনাস্থল থেকে হাতকড়া পরা অবস্থায়, গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময়, এমনকি থানা থেকে বলপূর্বক আসামি ছিনতাইয়ের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে গত কয়েক দিনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বইকি।
সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় পুলিশের কাছ থেকে একটি মারামারি মামলার প্রধান আসামিকে গ্রেফতারের পর তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঐ ঘটনার রেশ না কাটতেই গত শুক্রবার মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায় একজন এজহারভুক্ত আসামিকে পুলিশ গ্রেফতার করে থানাহাজতে রাখলে তাকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তাকে ছিনিয়ে নিতে একটি রাজনৈতিক দল ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহের উপজেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা একদল কর্মী নিয়ে থানায় উপস্থিত হন। বিক্ষোভ প্রদর্শন, বাগ্বিতণ্ডা, হট্টগোল, পুলিশকে মারধর ও থানা ভাঙচুরের মাধ্যমে জোরপূর্বক ওসি ও সার্কেল এসপির সামনে থেকেই তারা আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যান। উদ্ভূত এই ঘটনায় ৩১ জনের নাম উল্লেখসহ ২০১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আমরা জানি, আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান; কিন্তু এই নীতি উন্নয়নশীল দেশসমূহে বলতে গেলে অকার্যকর ও অচল।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট থেকে আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়া পুলিশের কর্তব্যকর্মে সরসারি বাধাপ্রদানের শামিল। সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্যকর্মে বাধাপ্রদানের বিষয়টি আমাদের পেনাল কোডের ১৮৬, ১৮৯, ৩৩২, ৩৩৩ ও ৩৫৩ ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। বিশেষত, ৩৩৩ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো সরকারি কর্মচারীকে সরকারি কর্মচারী হিসাবে তাহার কর্তব্যকর্ম সম্পাদন হইতে নিরস্ত বা ব্যাহত করিবার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত প্রদান করিলে উক্ত ব্যক্তি ১০ বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হইবে।’
মনে রাখতে হবে, থানা থেকে এজহারভুক্ত আসামি ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে থানা-পুলিশের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা যেটুকু ছিল, তা-ও বিনষ্ট হয়ে যাবে। এতে মানুষের অসহায়ত্ববোধ ও নিরাপত্তাহীনতা আরো বাড়বে নিঃসন্দেহে। তাই পুলিশের ন্যায়সংগত কাজে বাধা প্রদানকারীদের পরিচয় যা-ই হোক না কেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নে তাদের অবশ্যই গ্রেফতার করতে হবে।
৫ আগস্টের পর এমনিতেই দেশের থানা-পুলিশ নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাদের পরিবহন সমস্যা যেমন আছে, তেমনি কোথাও কোথাও জনবলের ঘাটতিও রয়েছে। জুলাই-আগস্টের রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। এ অবস্থায় রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সাধারণ নাগরিকদের সহায়তায় পুলিশের মনোবল বৃদ্ধিতে যেখানে কাজ করা প্রয়োজন, সেখানে তাদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং কর্তব্যকাজে বাধা প্রদান করা একদমই উচিত নয়। এক্ষেত্রে আমাদের ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন।
উপর্যুক্ত ঘটনায় প্রমাণিত হয়, আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অতীতে আমরা দেখেছি, স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে চলতেন। তাদের হুকুমমতো চলত স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের চাঁদাবাজি, হামলা-মামলায় সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠত। ৫ আগস্টের পরও যদি একই সংস্কৃতি ও পরিস্থিতি বিরাজ করে, তাহলে পরিবর্তনটা কোথায় হলো? এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক। এর পাশাপাশি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা দেওয়া, আবার সেই মামলা তুলে নেওয়া, মামলা-বাণিজ্যের আশ্রয় নেওয়া ইত্যাদিও যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্থক্য এই যে, আগে ছিল কম; কিন্তু এখন এ ধরনের মামলার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে ও পাচ্ছে। সুতরাং, এখন যদি আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের নিকট আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুল মেসেজ যাবে স্বাভাবিকভাবেই। আর তাতে করে জনমনে এই প্রশ্নও উঠতে পারে যে, তাহলে ঠিক কোন দিকে যাচ্ছি আমরা?