কৈশোরের দুরন্তপনার ছলে বাড়তি কৌতূহল, পারিবারিক অশান্তি, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, বন্ধুদের কুপ্রচারণা, অসত্ সঙ্গ, নানা রকম হতাশা ও আকাশসংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যারা নেশা করে, তাদের অধিকাংশই জানে যে নেশা কোনো রকম উপকারী বা ভালো কাজ নয় এবং এটা মানুষের জীবনীশক্তি বিনষ্ট করে। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসন থেকে বিচ্যুতি ঘটলেই মানুষের চিন্তায়, কর্মে ও মননে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এই শূন্যতার ঘাটতি কখনো মেটে অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার আতিশয্যে আবার কখনো হতাশায় ডুবে। তখনই মস্তিষ্কে বাসা বাঁধে মাদকাসক্তি।
তরুণ সমাজের বহু মেধাবী ও সম্ভাবনাময় প্রতিভা মাদকের নেশার কবলে পড়ে অবক্ষয়ের পথ বেছে নিচ্ছে। যেহেতু মাদকাসক্তি ও নেশাজাতীয় দ্রব্য মানবসমাজের জন্য সর্বনাশ ও চিরতরে ধ্বংস ডেকে আনে, তাই ইসলামি আদর্শে মাদকদ্রব্যকে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
মাদকাসক্তদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, তাই যে কোনো অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে বিবেক বাধা দেয় না। মিথ্যা কথা বলা তাদের স্বাভাবিক বিষয়। কোনো ধরনের অপরাধবোধ তাদের স্পর্শ করে না; সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ে। ভালোবাসা বা স্নেহ-মমতাও তাদের স্পর্শ করতে পারে না। মাদক সেবনকারীর দেহমন, চেতনা, মনন, প্রেষণা, আবেগ, বিচারবুদ্ধি সবই মাদকের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
মাদকাসক্তরা শুধু নিজেদের মেধা ও জীবনীশক্তিই ধ্বংস করছে তা নয়, তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলাও বিঘ্নিত করছে নানাভাবে। যেসব পরিবারের সদস্য নেশাগ্রস্ত হয়েছে, সেসব পরিবারের দুর্দশা অন্তহীন। মাদকাসক্তি আসলে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির বিবেক-বুদ্ধি, বিচারক্ষমতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব, আদর্শ সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলে। এসব অনিষ্টকারিতা ও অপকারিতা গুরুতর অপরাধও।
যেহেতু মাদকাসক্তি একটি জঘন্য সামাজিক ব্যাধি, তাই জনগণের সামাজিক আন্দোলন, গণসচেতনতা ও সক্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমে এর প্রতিকার করা সম্ভব। যার যার ঘরে পিতামাতা থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাড়া, মহল্লা বা এলাকায় মাদকদ্রব্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ঘৃণা প্রকাশের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মাদকদ্রব্যের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে নিয়মিত সভা-সমিতি, সেমিনার, কর্মশালার আয়োজন করতে হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকের ভয়াবহ পরিণাম-সম্পর্কিত সতর্কতা ও শিক্ষামূলক ক্লাস নিতে হবে।
মাদক নিরাময়ে চাই পরিবারের আন্তরিকতা ও পারস্পরিক ভালোবাসা। পরিবারের পিতামাতাই সন্তানকে মাদকের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে পারেন। পিতামাতারা যদি তাদের ব্যস্ত সময়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ সন্তানের জন্য বরাদ্দ রাখেন, তাদের সামাজিক রীতিনীতি, বিধিবিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন শিক্ষা দেন, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করেন, তাদের জীবনের জটিল সমস্যাবলি সমাধানে অত্যন্ত সচেতন ও মনোযোগী হন, তাহলেই তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তি অনুপ্রবেশের সুযোগ থাকে না। মাদকদ্রব্য পরিত্যাগের ব্যাপারে আসক্ত ব্যক্তিদের স্বভাব বদলে আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলার জন্য আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হওয়া দরকার। অভিভাবক ও মুরুব্বিদের নিয়ে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় মাদক প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। মাদকাসক্তি ত্যাগে আসক্তদের উত্সাহিত ও ধর্মীয় সামাজিক অনুশাসন মেনে চলার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাতে হবে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে সাম্প্রতিক কালের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মতত্পরতা ও আন্তরিকতা সমাজের সবার নজর কেড়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগে বাংলাদেশ পুলিশের দৃঢ়তা সক্ষমতা ও কঠোরতা নজিরবিহীন। ইদানীং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে জড়িতদের আটক গ্রেফতার মাদকদ্রব্য উদ্ধার সন্তোষজনক। প্রচলিত ধ্যানধারণার বাহিরে এসে পুলিশ বিভিন্ন স্লোগানে মুখরিত হয়ে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা প্রতিরোধ ও আন্দোলন গড়ে তুলেছে। জনসম্পৃক্ত পুলিশিংয়ের মাধ্যমে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাদকবিরোধী আন্দোলনে সমাজের সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষদেরকে সম্পৃক্ত করতে পারলেই কেবল চূড়ান্ত সফলতা অর্জনের পথ সুগম হবে বলে প্রতীয়মান।
আমাদের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবন থেকে মাদকদ্রব্য উত্খাত এবং মাদকাসক্তি নির্মূল করতে হলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দরকার মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণ, সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ এবং ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন। এর জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে সচেতনতা জাগাতে হবে। প্রতিটি পরিবারপ্রধানকে সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে। পারিবারিক অনুশাসন, নৈতিক মূল্যবোধ ও সুস্থ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। পরিবারে শালীনতার সঙ্গে খেলাধুলা শরীরচর্চাব্যবস্থা করতে হবে। সুস্থ ধারার শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে রুচিসম্মত বিনোদনের মাধ্যমে অভিভাবকদের সঙ্গে পরিবারের তরুণ সদস্যদের মনের নৈকট্য ঘটলে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষার শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে। মাদকের বিরুদ্ধে বর্তমান বিশ্বব্যাপী যে প্রতিরোধ আন্দোলন ও যুদ্ধ, তার সূতিকাগার হতে হবে আমাদের পরিবারগুলো।
বর্তমান প্রজন্মের অগ্রযাত্রাকে প্রাণঘাতী নেশার ভয়াবহ থাবা থেকে রক্ষার জন্য মাদকের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, এর কুফল সম্পর্কে ব্যাপকভাবে তথ্য প্রদান ও প্রচার করতে হবে। সর্বগ্রাসী মাদক যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। আমরাই মাদককে নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করব। খেলাধুলা, বিনোদন, সৃজনশীলতা, কল্যাণ, শান্তি ও অবারিত সৌন্দর্যের জন্য প্রস্ফুটিত হবে নির্মল নিষ্পাপ আমাদের হাসিমুখর ফুলকুড়িরা। এটাই হোক আমাদের আজকের প্রতিজ্ঞা ও মূলমন্ত্র।
লেখক : অফিসার ইনচার্জ, বাকেরগঞ্জ থানা, বরিশাল