কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখিয়াছেন: ‘এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার‘। পৃথিবীর নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত ও বঞ্চিত শিশুদের জন্য তিনি এক নতুন পৃথিবী গড়িবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করিলেও সেই পৃথিবী আজও অধরা। যেখানে ফিলিস্তিন, লেবানন, ইউক্রেনসহ বিশে^র নানা দেশে যুদ্ধ, সংঘাত ও হানাহানির কারণে শিশুরা অকাতরে প্রাণ দিতেছে, যেখানে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে প্রতিনিয়ত শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা বাড়িয়া চলিয়াছে, সেইখানে প্রতীয়মান হয় সারা বিশ্বের শিশুদের জন্য সুকান্ত আজও প্রাসঙ্গিক।
শিশুরা ফুলের মতো পবিত্র। তাহারা আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। বলা হয়: ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুর অন্তরে‘। কিন্তু এইসব কথা নিছক বুলি ছাড়া আর কিছুই নহে। কেননা আজও নিষ্পাপ শিশুরা যেভাবে নির্যাতিত এমনকি নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যার শিকার হইতেছে তাহার খবর পড়িয়া আমাদের বিস্মিত, শিহরিত ও বিমূঢ় হইতে হয়। গতকাল ইত্তেফাকের এক খবরে বলা হইয়াছে, চলতি বৎসরের ৯ মাসে দেশে হত্যার শিকার হইয়াছে ৪৫৪ জন শিশু। তাহাদের মধ্যে ৭৭ জনের বয়স শূণ্য হইতে ছয় বৎসর। বিশেষ করিয়া কিছুদিন আগে সিলেটের কানাইঘাট হইতে নিখোঁজ হওয়া শিশু মুনতাহা আক্তারকে (৫) অপহরণের পর যেইভাবে তাহাকে হত্যা করা হইয়াছে তাহা এখনও টক অব দ্য কান্ট্রি। তাহাকে হত্যা করিয়া লাশ গুম করিতে ডোবায় পুঁতিয়া রাখা হইয়াছিল। তাহাকে হত্যার সহিত জড়িত তাহারই এক সাবেক গৃহশিক্ষক ও প্রতিবেশি। বিষয়টি ভাবা যায়?
২০১৯ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন তাহাদের অভিভাবক, শিক্ষক ও পরিচর্যাকারীদের নিকট হইতে সহিংস শাস্তি ও আগ্রাসী ব্যবহারের শিকার হয়। অথচ শৈশবে সহিংসতা হইতে তৈরি উদ্বেগ শিশুদের মস্তিষ্কের প্রবৃদ্ধিকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করিতে পারে এবং স্নায়ুতন্ত্রের অন্যান্য অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করিতে পারে। তাই পৃথিবীব্যাপী শিশুর প্রতি সব ধরনের নৃশংসতা ও সহিংসতা বন্ধ করিতে হইবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী আরেকটি ভয়াবহ তথ্য হইল, গত সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় অক্টোবরে দেশে শিশু ধর্ষণ বৃদ্ধি পাইয়াছে ৯১ শতাংশ। আমাদের দেশে অনেক সময় বাবা—মায়ের ওপর প্রতিশোধ নিতে শিশুদের প্রতি নির্যাতন চালানো হয়। আবার তাহারা আত্মীয়—স্বজন ও পাড়া—প্রতিবেশি তথা পরিচিত মানুষদের মাধ্যমেও নির্যাতিত বা হত্যার শিকার হয়। যেমন— অভিভাবকদের পরকীয়ার বলি কিংবা পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা ও প্রতিহিংসারও শিকার হয় তাহারা। অথচ শিশুর নিরাপত্তার প্রশ্নে সাংবিধানিক বিধান ও আইন রহিয়াছে। এই সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদেও আমরা স্বাক্ষর করিয়াছি। কিন্তু তাহা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা সীমাহীন ও অমার্জনীয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী ফিলিস্তিনের গাজা যুদ্ধে নিহতদের প্রায় ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। আবার আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের মধ্যে ৪ লাখই ছিলো শিশু—কিশোর। আর যেসব নারী সম্ভ্রম হারান তাহাদের মধ্যে অর্ধেকই ছিলো কিশোরী। এমনকি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিসাবে মতে, ২০২৪ সালের গণঅভূত্থানে নিহত হইয়াছে ১০৫ জন শিশু। অর্থাৎ সবখানে শিশুরাই যেন সহজ টার্গেটে পরিণত হইতেছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন তাহাদের অভিভাবক, শিক্ষক ও পরিচর্যাকারীদের নিকট হইতে সহিংস শাস্তি ও আগ্রাসী ব্যবহারের শিকার হয়। অথচ শৈশবে সহিংসতা হইতে তৈরি উদ্বেগ শিশুদের মস্তিষ্কের প্রবৃদ্ধিকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করিতে পারে এবং স্নায়ুতন্ত্রের অন্যান্য অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করিতে পারে। তাই পৃথিবীব্যাপী শিশুর প্রতি সব ধরনের নৃশংসতা ও সহিংসতা বন্ধ করিতে হইবে।
শিশুদের প্রতি এই নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার কি শেষ নাই? আমরা মনে করি, শিশু নির্যাতন ও হত্যা বন্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের বাস্তবায়ন সবচাইতে জরুরি। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ইহার সহিত জড়িত আসামীদের দ্রুতগতিতে গ্রেপ্তার ও বিচার সম্পন্ন করিয়া দণ্ড কার্যকর নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যেই ধরনের শিশু নির্যাতন হউক না কেন, এ ক্ষেত্রে রায় কার্যকরের সময়সীমা বাঁধিয়া দিতে হইবে। তাহা হইলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি হইতে বাহির হইয়া আসা সম্ভব হইতে পারে। পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি ও অস্থিরতার কারণেও শিশু নির্যাতন ও শিশুহত্যার মতো অপরাধ বৃদ্ধি পাইয়া থাকে। এইজন্য এই ব্যাপারেও আমাদের সজাগ ও সচেতন হইতে হইবে। উদ্বেগের বিষয় হইল, আমরা প্রযুক্তিতে উন্নয়ন করিতেছি ঠিকই; কিন্তু আমাদের মানবিক গুণাবলির কোনো উন্নয়ন হইতেছে না। তাই আমাদের একটি মানবিক পৃথিবী ও সমাজ গঠন করিতে হইবে এবং সুদৃঢ় করিতে হইবে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন।