কল্পনা করুন— আপনি একটি তাৎক্ষণিক বার্তা চেক করতে ফোন হাতে নিয়েছেন। আর মিনিট ত্রিশ পরে দেখলেন, আপনি অবিরত সংবাদ শিরোনাম আর বিড়ালের ভিডিওর ভিড়ে ডুবে আছেন। এর মধ্যে আপনি কেন ফোন হাতে নিয়েছিলেন, তা ভুলেই গেছেন! এই ঘটনা কি পরিচিত মনে হচ্ছে? এটি শুধু আধুনিক জীবনের মজার ঘটনা নয়, বরং এটি এক গভীর সামাজিক পরিবর্তনের প্রতীক।
আমাদের মনোযোগ ক্রমেই কমছে এবং এর প্রভাব বিশাল। গবেষণা বলছে, গত দুই দশকে গড় মানুষের মনোযোগ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্লোরিয়া মার্ক ২০০৪ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, কোনো একটি কাজে মানুষের গড় মনোযোগ ছিল আড়াই মিনিট। কিন্তু ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৪৭ সেকেন্ডে। বাংলাদেশেও স্মার্টফোনের ব্যবহারের ব্যাপক বিস্তারের ফলে চিত্র আলাদা নয়। এই পরিবর্তন আমাদের চিন্তাভাবনা, কাজ এবং জীবনযাত্রার উপর বিশাল প্রভাব ফেলছে—যা সবসময় ইতিবাচক নয়।
এই সংকটের মূল কারণ হলো প্রযুক্তি। স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ২৪/৭ সংযুক্ত থাকার যুগে মনোযোগ নষ্টকারী বিষয় সর্বত্র। নোটিফিকেশন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দিতে বাধ্য করে। অ্যালগরিদম আমাদের পছন্দ অনুযায়ী কন্টেন্ট সাজিয়ে দেয়, এবং “আরেকটু স্ক্রল করি” প্রবৃত্তি আমাদের থামতে দেয় না। ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের ডোপামিন পাথওয়েকে কাজে লাগিয়ে আমাদের আটকে রাখে।
এই ডিজিটাল পরিবেশে ‘নিরবচ্ছিন্ন আংশিক মনোযোগ’ নামে পরিচিত একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফোকাসড মনোযোগ যেখানে গভীরভাবে কোনো কাজে নিমগ্ন হতে দেয়, সেখানে এই আংশিক মনোযোগ আমাদের মনোযোগ বিভিন্ন প্রভাবকের মধ্যে ভাগ করে দেয়। ফলে, মন একটি কাজেও বেশি সময় ধরে মনোনিবেশ করতে পারে না।
মানব মস্তিষ্ক অসাধারণভাবে অভিযোজনশীল। নিউরোপ্লাস্টিসিটি বা মস্তিষ্কের নিজেকে পুনর্গঠন করার ক্ষমতা আমাদের আচরণের পুনরাবৃত্তি দেখে নিউরাল পাথওয়ে পরিবর্তন করে। অ্যাপের মধ্যে ঘন ঘন পরিবর্তন বা মাল্টিটাস্কিংয়ের মতো অভ্যাসের ফলে, মস্তিষ্ক দ্রুত, পৃষ্ঠতল তথ্য প্রক্রিয়াকরণের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে গভীর ও স্থায়ী চিন্তাভাবনার দক্ষতা হারিয়ে যায়।
গবেষণাগারে এমআরআই স্ক্যান দেখিয়েছে, নিয়মিত মাল্টিটাস্কিং নির্দিষ্ট স্নায়বিক নেটওয়ার্ককে অতিরিক্ত সক্রিয় করে, যা মানসিক ক্লান্তি এবং কম কার্যকারিতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষণা বলছে, একজন ব্যক্তি প্রতিদিন গড়ে ৩৪ গিগাবাইটের সমপরিমাণ তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করেন। এই তথ্যের ভার আমাদের জ্ঞানীয় ক্ষমতাকে বিভ্রান্ত করে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফিল্টার করা কঠিন করে তোলে। বাংলাদেশে, যেখানে ডিজিটাল রূপান্তর দ্রুতগতিতে চলছে, এই চ্যালেঞ্জ আরও স্পষ্ট। স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, এবং অনলাইন যোগাযোগ প্রতিদিনের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে, দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি এবং ডিজিটাল রূপান্তরের প্রভাবে মনোযোগ সংকটের প্রভাব তীব্র। শহরাঞ্চলে যেমন ঢাকা, “হাসল কালচার” মানুষকে মাল্টিটাস্কিং ও অতি উৎপাদনশীলতায় বাধ্য করছে। একাধিক কাজ, পরিবার, এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের চাপে গভীর কাজে নিমগ্ন হওয়ার সময় পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
সোশ্যাল মিডিয়ার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার। ফেসবুক ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়; সেগুলি অত্যন্ত কৌশলে আমাদের মনোযোগ ধরে রাখতে ডিজাইন করা হয়েছে। লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ারের অবিরাম প্রবাহ আমাদের মস্তিষ্কের পুরস্কার ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে, যা আমাদের স্ক্রিনের দিকে আটকে রাখে। বাংলাদেশে, যেখানে ফেসবুক ব্যবসায়িক প্রচারণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এই আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়া আরও কঠিন।
এই স্ক্রিনের প্রতি আসক্তির মূল্য বেশ চড়া। অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সঙ্গে উদ্বেগ, হতাশা এবং মনোযোগ ঘাটতির মতো সমস্যার সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে মানুষ দিনে ৯৬ বার ফোন চেক করেন, যা প্রতি ১০ মিনিটে একবার। কর্মস্থলে কর্মীরা প্রতি ৩ মিনিটে একবার কাজ পরিবর্তন করেন, এবং বাধা কাটিয়ে আবার ফোকাস করতে গড়ে ২৩ মিনিট সময় লাগে।
বাংলাদেশে, গত এক দশকে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের হার ৩০০% বেড়েছে। এই প্রবণতা শুধুমাত্র বিরক্তিকর নয়; এটি ব্যয়বহুলও। বারবার মনোযোগ বদলানো এবং বাধার কারণে উৎপাদনশীলতা প্রায় ৪০% কমে যায়।
এই সংকট অপ্রত্যাবর্তনীয় নয়। সচেতনতা হলো প্রথম পদক্ষেপ। মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলে কীভাবে প্রভাব ফেলে তা বুঝে আমরা নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনতে পারি। মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন, ডিজিটাল ডিটক্স এবং সময় ভাগ করার মতো কৌশলগুলো মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দিতে পারে। প্রতিষ্ঠানগুলোও গভীর কাজকে অগ্রাধিকার দিয়ে অপ্রয়োজনীয় ব্যাঘাত কমিয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশে একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন প্রয়োজন। নিয়োগকর্তাদের উচিত গভীর কাজের মূল্য স্বীকার করা এবং “সবসময় চালু” সংস্কৃতি নিরুৎসাহিত করা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে, প্রযুক্তি ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ—যেমন নোটিফিকেশন বন্ধ করা বা স্ক্রিন-মুক্ত সময় নির্ধারণ—গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষা ব্যবস্থাকেও শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা শেখানোর জন্য অভিযোজিত হতে হবে।
শেষ কথা : এই লেখাটি পড়া শেষ করার সময় একটু চিন্তা করুন: আপনি কতবার ফোন চেক করতে বা অন্য কিছু করার জন্য প্রলুব্ধ হয়েছিলেন? এই পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাই আমাদের আলোচ্য সমস্যার প্রমাণ। আমাদের মনোযোগের সংকট শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়; এটি একটি সামাজিক চ্যালেঞ্জ, যা যৌথ প্রচেষ্টা দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে।
আমাদের প্রশ্ন হওয়া উচিত নয় যে আমরা এই বিভ্রান্তিকর পৃথিবীর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারব কি না—আমরা ইতিমধ্যেই তা পেরেছি। আসল প্রশ্ন হলো, আমরা কি গভীরভাবে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা, সমালোচনামূলক চিন্তা করার দক্ষতা, এবং অর্থবহ সংযোগ স্থাপনের সামর্থ্য ফিরে পেতে পারব? এটি সম্ভব হলে, আমরা শুধু আমাদের মনোযোগই নয়, আমাদের মানবিকতাও পুনরুদ্ধার করতে পারব।
লেখক : অটোনোমাস ভেহিকল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পোস্টগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নেপল, ইতালি।