আমরা মহান বিজয়ের ৫৩ বছর পেরিয়ে এসে কিছু জিনিস আমাদের ফিরে দেখা খুবই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে দেশে যে প্রজন্ম আমরা প্রত্যক্ষ করছি তাদের অনেকেরই প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। এই অর্ধশতাব্দীকালে যারা দেশ শাসন করেছেন তারা নিজেদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাখ্যা বা মূল্যায়ন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ কোনো তাত্ক্ষণিক ঘটনার ফল নয় বা এটা শুধু ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল না। এর প্রেক্ষাপট অনেক গভীরে প্রোথিত। দুই শত বছরের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম। পরবর্তীকালে ২৪ বছর পাকিস্তানি শাসক চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। যে প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। পাকিস্তানের শাসনাধীনে বাংলাদেশের মানুষ ছিল অধিকারবঞ্চিত। মূলত এসব কারণেই বাংলাদেশের মানুষ একসময় পাকিস্তানি শাসক চক্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দেখতে পাই, এই অঞ্চলে যে সম্পদ আছে, ব্রিটিশরা তা নানাভাবে লুটপাট করে নিজ দেশে নিয়ে যেত। ফলে এ দেশের মানুষ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়। জাতীয় পর্যায়ে যেমন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন হয়েছে, তেমনি স্থানীয় পর্যায়েও বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। তাদের একটি ধারণা ছিল, যদি ব্রিটিশদের এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে স্থানীয়দের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ব্রিটিশবিহীন অবস্থায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সাধারণ মানুষ ন্যায্যতার ভিত্তিতে উত্পাদিত সম্পদ ভোগ করার অধিকার অর্জন করবে।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বিপ্লবী সরকার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন, সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে স্বাধীন দেশ ঘোষণা করলাম, তার প্রধান তিনটি কাজ হবে সাম্যের দেশ গঠন করা, সবার জন্য মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন দেশ গঠন করা হবে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এই তিনটি আদর্শের ভিত্তিতেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিচার করতে হবে। ব্রিটিশবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে ২৪ বছরের আন্দোলনের মাধ্যমেই এই চেতনা বিকশিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে যে সংবিধান পাশ হয় তাতে বেশ কিছু অসংগতি ছিল। বামপন্থি প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি অনুমোদিত সংবিধানের সমালোচনা করে। সংবিধানে যেসব অসংগতি আছে তা দূর করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল। জাতীয় সংসদ এবং সংসদের বাইরে থেকে সংবিধানের বিষয়ে কিছু সংশোধনী এবং পরিবর্তন আনয়নের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেই সময় যদি সংশোধনীগুলো আনা হতো তাহলে আমাদের সংবিধান আরো বেশি মানবিক ও জনকল্যাণমূলক হতে পারত। কিছু ত্রুটি থাকলেও সংবিধানের যে মূল চার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তা এই দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেছিল।
স্বাধীনতা অর্জনের ৫৩ বছর পর যদি আমরা পেছনে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখব, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য বা চেতনা ছিল সাম্যের সমাজ গড়া। কিন্তু সেটা আমরা এখনো গড়তে পারিনি। বরং দিনদিন আমাদের সমাজে বৈষম্য বেড়েই চলেছে। আগে বৈষম্য ছিল পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে। আর এখন বৈষম্য গড়ে উঠেছে একই দেশের দুইটি শ্রেণির মধ্যে। এই বৈষম্য দিনদিন বাড়ছেই। বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা অর্জন করে অর্থাত্ ১৯৭১ সালে, সেই সময় মানুষের মধ্যে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে। স্বাধীনতা অর্জনের এত বছর পর বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য ভয়াবহ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষ ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভোগ করতে পারছে না। উন্নয়নের সুফল সামান্য কিছু সুবিধাভোগী মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সমাজে বিত্তবান শ্রেণি আরো বিত্তবান হচ্ছে। বিত্তহীন মানুষ ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। সংবিধানে বলা আছে, আমাদের প্রধান বা প্রথম উত্পাদন খাত হবে রাষ্ট্রীয় খাত। দ্বিতীয় খাত হবে সমবায় খাত। তৃতীয় বিষয় হবে আইনের দ্বারা নির্ধারিত হিসাবের ওপর দাঁড়িয়ে ব্যক্তি খাতের বিকাশ ঘটানো। একই সঙ্গে আরো বলা হয়েছে, কোনো অনুপার্জিত আয় ভোগ করা যাবে না। আমরা যদি সংবিধানে বর্ণিত অর্থনৈতিক অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করতে পারতাম, তাহলে দেশে এমন বৈষম্য সৃষ্টি হতো না। গত ৫৩ বছরে আমরা দেশে যে বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছি, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া অন্য স্বাধীনতা মূল্যহীন।
এ দেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বাস করে। প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ ধর্ম প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে পালনের অধিকার রয়েছে। কিন্তু প্রায়ই আমরা এক্ষেত্রে ব্যত্যয় লক্ষ করি। দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকদের স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই সব শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের এই অধিকার সমভাবে দেওয়া হয়নি। জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য আমরা মানবিক মর্যাদা সমভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। স্বাধীনতার এত বছর পরও আমাদের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। অবস্থা এমন হয়েছে, যার হাতে টাকা আছে তার জন্যই বিচার আছে। বিভিন্ন সময় যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন তারাই ব্যক্তিতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে বিচার বিভাগকে কুক্ষিগত করে নিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে শুধু বর্তমানেই বিঘ্নিত হচ্ছে তা নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই এটা শুরু হয়েছে। এখন তা চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে আমাদের ব্যর্থতার জন্য নানা কারণ দায়ী। অনেকেই মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা অর্জন হচ্ছে আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেলাম, একটি পতাকা পেলাম। কিন্তু মুক্তযুদ্ধের চেতনা এর মধ্যেই সীমিত নয়। আর এগুলোর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হয় না। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা, গণমানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই আমরা বাস্তবায়ন বা অর্জন করতে পারিনি। আমরা স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, যা পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনাকে ভেঙে একটি নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন করবে। কিন্তু যারাই বিগত দিনে দেশ শাসনের দায়িত্ব পেয়েছেন তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শের পরিবর্তে একটি নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজটি করেননি। পাকিস্তান আমলে শাসক এবং জনগণের মধ্যে যে বৈষম্য বিদ্যমান ছিল স্বাধীন বাংলাদেশেও শাসকগোষ্ঠী সেই বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করেছে এবং বিস্ময়করভাবে তারা সফলতাও অর্জন করেছে।
সামাজিক সম্প্রীতি, অর্থনৈতিক সুষম বণ্টন, কর্মসংস্থান, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা কোনো ক্ষেত্রেই আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি। এখন আমাদের দেশে ব্রিটিশ বা পাকিস্তানিরা নেই। কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ এখনো আছে, যারা মনেপ্রাণে পাকিস্তানি চেতনাকে ধারণ করে থাকেন। এখন এক দেশে দুই ধরনের অর্থনীতি চালু আছে। একটি হচ্ছে বড়লোকের অর্থনীতি আর অন্যটি বঞ্চিত মানুষের অর্থনীতি। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বৈষম্য দিনদিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ভাঙতে গেলে যে ধরনের নীতিনিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন, তা আমাদের দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য ভাঙতে গেলে প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রয়োজন প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মাত্রায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।
২০২৪ সালে এসে আমরা এক নতুন প্রেক্ষাপটে বিজয় দিবস পালন করলাম। ছাত্ররা যে আন্দোলন করেছে তার মূল বক্তব্য বা দাবি ছিল সর্বক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের মানুষের মধ্যে বিরল ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এবারের ছাত্র আন্দোলনে ঠিক তেমনি ঐক্য গড়ে উঠেছিল। ’৯০-এর গণআন্দোলনের মাধ্যমেও জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই ঐকমত্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। এবার যে ঐকমত্য গড়ে উঠেছে তাকে ধারণ করে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন এবং বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে সচেষ্ট হতে হবে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)