ডোনাল্ড ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার পরিকল্পনা এবং নতুন মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এ বিষয়ে তার ‘নতুন আগ্রহ’ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এ ঘটনা বেশ উত্তাপ ছড়ালেও ইস্যুটিকে বেশি বড় করে দেখার সময় এখনো আসেনি।
ইতিমধ্যে অনেকের প্রতিক্রিয়ায় এমন ভাব ফুটে উঠেছে, যেন তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছেন এই ভেবে যে, ‘এবার ট্রাম্প আসলে কী করতে যাচ্ছেন?’ সম্প্রতি ট্রাম্প এক মন্তব্যে বলেছেন যে, প্রয়োজনে অর্থনৈতিক অথবা সামরিক শক্তি ব্যবহার করে হলেও গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে ওয়াশিংটন। ট্রাম্পের বক্তব্যের পর বিশ্বনেতারা সরব হয়েছেন, দিচ্ছেন সতর্কবার্তা। জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সীমানার অখণ্ডতা বজায় রাখার বিষয়কে তারা ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অবশ্য ট্রাম্পের বক্তব্যে সার্বভৌমত্বের গুরুত্বকে হালকা করে দেখানো হয়নি।
মূলত জাতীয় সীমানার অখণ্ডতা এবং আইনশৃঙ্খলার গুরুত্ব এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে তর্কবিতর্ক অবান্তর। তবে সাংবাদিকদের জন্য এটা প্রায়শই ‘একটি কৌশলগত পদ্ধতি’ হয়ে উঠতে দেখা যায়, যেখানে তারা রাজনীতিবিদদের মুখ দিয়ে এমন কিছু বলাতে চান, যা পরবর্তী সময়ে ‘বিতর্কিত ইস্যুতে’ পরিণত হয়ে ওঠে! যদিও দিন শেষে এটি একটি ‘অর্থহীন অনুশীলন’ বই আর কিছুই নয়।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং দ্য কনভারসেশনের নিয়মিত লেখক স্টেফান উলফের একটি বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উলফ তার নিবন্ধে দেখিয়েছেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নন, যিনি গ্রিনল্যান্ড কেনার কথা বলেছেন। বরং ১৮৬৮ সালে ধারণাটি প্রথম ওঠে আসে তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম এইচ সিওয়ার্ডের সময়ে। পরবর্তী সময়ে বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে ইস্যুটি। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৬ সালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান গ্রিনল্যান্ড কেনার জন্য ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
গ্রিনল্যান্ড কেনার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণগুলোও খুবই সুস্পষ্ট। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো, এই দ্বীপের বিপুল খনিজ সম্পদ এবং কৌশলগত অবস্থান। তবে উলফ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, ট্রাম্পের কূটনৈতিক পদ্ধতি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েই যায়। কারণ, খোদ গ্রিনল্যান্ডের জনগণ নিজেরাই ডেনমার্ক থেকে স্বাধীন হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, ডেনমার্ক একটি ন্যাটো সদস্য এবং গ্রিনল্যান্ড ১৯৭৯ সাল থেকে ডেনমার্কের সঙ্গে একটি স্বায়ত্তশাসনের চুক্তিতে আবদ্ধ। এমন একটি অবস্থায়, তথা বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে, ন্যাটো জোট দুর্বল হয়ে পড়বে—এমন কাজ না করা। যদিও ট্রাম্প এই বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছেন কি না, তা স্পষ্ট নয়।
গ্রিনল্যান্ডের পাশাপাশি ট্রাম্পের নজর পড়েছে পানামা খালের (পানামা ক্যানল) দিকে। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য এই খালটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়েও বিতর্ক তুঙ্গে! এই খাল নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় জিমি কার্টারের মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ পর। ১৯৭৭ সালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার পানামাকে খালটির মালিকানা হস্তান্তর করেন, যা তার সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ল্যাংকাাস্টার ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপক আমলেন্দু মিশ্র পানামা খালের ইতিহাস এবং এর গুরুত্ব সমপর্কে একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পানামা খাল নির্মাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প ছিল, যা সে সময়ের সবচেয়ে বড় নির্মাণ প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। ট্রাম্পের বক্তব্য, খালটি পানামার কাছে হস্তান্তর করা ঠিক হয়নি। কারণ, তার ধারণা, খালটি এখন চীনের নিয়ন্ত্রণে।
তবে মিশ্র দেখিয়েছেন, খালের উভয় প্রান্তে অবস্থিত বন্দরগুলো হংকংভিত্তিক কোম্পানি হাচিসন ওয়াম্পেয়ারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হলেও আদতে খালটি পরিচালনা করে স্বাধীন সরকারি সংস্থা ‘পানামা খাল কর্তৃপক্ষ’। কার্টারের চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র আইনি উপায়ে খালের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে না। তবে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে এটি সম্ভব হতে পারে। যারা ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পানামা আক্রমণের কথা মনে রেখেছেন, তাদের জানার কথা—তখন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশ এই অভিযান চালান, যা ‘অপারেশন জাস্ট কজ’ নামে পরিচিত।
চীন গত দুই দশকে ল্যাটিন আমেরিকার অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্টের (আইএমডি) জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ হোসে ক্যাবালিয়েরো এক মন্তব্যে বলেছেন যে, চীন এই অঞ্চলে তার অবস্থান আরো শক্তিশালী করতে প্রস্তুত। তার মতে, এই অঞ্চল চীনের প্রতি আরও ঝুঁকছে।
২০০২ সাল থেকে চীন ও ল্যাটিন আমেরিকার মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২৩ সালে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ২০২৪ সালের প্রথম দুই মাসেই চীনের ল্যাটিন আমেরিকায় রপ্তানি ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ক্যাবালিয়েরোর দাবি, ‘চীন তার অংশীদারিত্ব আরো প্রসারিত করতে পুরোপুরি প্রস্তুত এবং সুযোগ পেলেই বেইজিং তা কাজে লাগাবে।’
এদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিমালা এবং বাড়তি শুল্কের কারণে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে, ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক বক্তব্য জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দিতে পারে যে কোনো সময়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প মেক্সিকো উপসাগরকে ‘আমেরিকা উপসাগর’ নামকরণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ঐ ঘটনাকে ‘অত্যন্ত অস্বস্তিকর’ হিসেবে অভিহিত করেন অনেকে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে ট্রাস্প প্রশাসন যদি আরো বেশি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতিতে’ পরিচালিত হয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পথে এগোয়, তাহলে চীন স্পষ্টভাবে এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসবে। ইতিমধ্যে বেইজিং সে ধরনের সক্ষমতার জানানও দিয়েছে। চীনের ইঙ্গিত স্পষ্ট—তারা ল্যাটিন আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে প্রস্তুত।
সাম্প্রতিক সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও এলন মাস্কের মধ্যকার সম্পর্কও আলোচনার বড় বিষয় হয়ে ওঠে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে উঠে আসা এই প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এবং নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প—দুই জনই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আগ্রাসী কৌশলের জন্য পরিচিত! তাদের আচরণ অনেকাংশে ‘একই কৌশলগত নির্দেশনা’ অনুসরণ করছে বলে প্রতীয়মান। যদিও ইউসিএলের মার্কিন রাজনীতি বিশেষজ্ঞ থমাস গিফট তার এক বিশ্লেষণে উল্লেখ করেছেন যে, মাস্ক ধীরে ধীরে ট্রাম্পের সমর্থকদের সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন।
গিফট মনে করেন, এর প্রধান কারণ হলো অভিবাসন নীতি। বিশেষ করে এইচ১-বি ভিসা নিয়ে বিতর্ক। এই ভিসা মূলত বিশেষ দক্ষতা এবং প্রতিভা সমপন্ন অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করার সুযোগ দেয়, যা প্রযুক্তিশিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়। সিলিকন ভ্যালি এবং এলন মাস্ক নিজেও এ ধরনের ভিসার মাধ্যমে বিদেশি প্রতিভা নিয়োগ করে থাকেন।
অন্যদিকে, স্টিভ ব্যাননের মতো জাতীয়তাবাদী নেতারা এ নীতির ঘোরবিরোধী। ব্যানন, যিনি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তার নীতির প্রধান আদর্শিক পরামর্শদাতা ছিলেন, মনে করেন যে এইচ১-বি ভিসা পুরোপুরি একটি প্রতারণামূলক ব্যবস্থা। তার মতে, দেশকে ব্যাপক অভিবাসনের ওপর নির্ভরশীল না করে বরং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ প্রতিভাকে প্রশিক্ষিত করা উচিত। গিফটের মতে, এ নীতি নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা বিশ্বায়ন এবং অভিবাসন নীতি সম্পর্কে গভীর বিভক্তি সৃষ্টি করছে। এতে করে ট্রাম্প এবং মাস্কের মধ্যকার সম্পর্কের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে যে কোনো সময়!
লেখক : কনভারসেশনের জ্যেষ্ঠআন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক
দ্য কনভারসেশন থেকে অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল মামুন