ঢাকায় বায়ুদূষণের সমস্যাটি দীর্ঘকাল ধরেই জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি গভীর সংকটরূপে পরিগণিত হচ্ছে। বাইরের দূষিত বায়ু যে নাগরিক জীবনের শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, তা সর্বজনবিদিত। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় উন্মোচিত হয়েছে যে, বাইরের পাশাপাশি ঘরের অভ্যন্তরেও বায়ুদূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে নাগরিক স্বাস্থ্য উপনীত হচ্ছে আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। ঢাকায় বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ঘরের অভ্যন্তরে পিএম-২.৫ দূষণের গড় মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত সীমার প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। কিছু ঘরে এর মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রোগ্রামেরও বেশি, যা বাসিন্দাদের শারীরিক সুস্থতার জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। বিশেষত নারী, শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা এতে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ঘরের বায়ুদূষণের মূল কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হলো, বাইরের দূষিত বায়ুর অনুপ্রবেশ, দীর্ঘসময় রান্না করা এবং বায়ু চলাচলের অপ্রতুল ব্যবস্থা। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বাইরের দূষিত বায়ু জানালা কিংবা অন্য ছিদ্রপথে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে, যা দূষণের প্রায় ৪০ শতাংশের জন্য দায়ী। রান্নার সময়ে পিএম-২.৫-এর মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত, যখন রান্নার সময়কাল দেড় ঘণ্টার বেশি হয়, তখন এর প্রভাব আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে। ঘরের বায়ুদূষণকে উপেক্ষা করে এর প্রভাব হতে রক্ষা পাওয়া যায় না। ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণায় বায়ুদূষণকে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার, এমনকি মস্তিষ্কজনিত রোগের সহায়ক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা, অর্থাৎ পিএম-২.৫, মানবদেহে প্রবেশ করে রক্তনালী ও হৃদযন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করছে।
বায়ুদূষণের প্রভাব হতে রক্ষা পেতে এর উৎস চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য। এর মধ্যে প্রধান হলো, ঘরের বায়ুচলাচল ব্যবস্থার উন্নয়ন। জানালা ও দরজার নকশায় এমন পরিবর্তন আনতে হবে, যা বাইরের দূষিত বায়ুর অনুপ্রবেশ রোধ করবে। রান্নার সময় দূষণ কমানোর জন্য উন্নতমানের ও পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত। তদুপরি, নিয়মিত ঘর পরিষ্কার রাখা বায়ুদূষণ হ্রাসে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ছোট ঘরের তুলনায় বড় ঘরে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি দেখা গেছে, যা ঘরের আয়তনের ভিত্তিতে বিশেষ পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তাকে নির্দেশ করে। উন্নত বিশ্বে বায়ুদূষণ রোধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তার মধ্যে প্রধান হলো শক্তিশালী পরিবেশ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০সালের ‘ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট‘ কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। ইউরোপীয় দেশসমূহে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির প্রসারে বিপুল বিনিয়োগ করা হয়েছে। উন্নত শহরগুলোতে যানবাহনের দূষণ কমাইবর জন্য ‘স্মার্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম’ চালু করা হয়েছে। এর পাশাপাশি, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যবহার উৎসাহিত করা হচ্ছে। শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, উন্নত দেশসমূহ নাগরিক সচেতনতার উপরও বিশেষ জোর দিয়েছে। যেমন, জাপানে স্কুল পর্যায়ে পরিবেশগত শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা নাগরিকদের মধ্যে দূষণ প্রতিরোধে দায়িত্বশীল আচরণ গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে।
বাংলাদেশে বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হলো ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য এবং নির্মাণকাজ। ঘরের অভ্যন্তরের দূষণেও রান্নার ধোঁয়া, নিম্নমানের জ্বালানি এবং বায়ুচলাচলের অভাব একটি বড় ভূমিকা রাখে। এই সমস্যা সমাধানে উন্নত বিশ্বের নীতিগুলির অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি। বায়ুদূষণ প্রতিরোধে উন্নত বিশ্বের পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য একটি কার্যকর দৃষ্টান্ত। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাকে বিবেচনা করে একটি সুসংগঠিত ও বাস্তবায়নযোগ্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। প্রশাসন, বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়-ই কেবল এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব। সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব হলে এটা শুধু পরিবেশ নয়, মানবজাতির ভবিষ্যৎকেই বিপন্ন করবে। অতএব, এখনই সচেতন হয়ে বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াই শুরু করাটা আমাদের দায়িত্ব।