সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন নিজ দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে বদ্ধপরিকর, তখন আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। তবে বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চল এখনো পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে, সারা দেশের চরাঞ্চলগুলি যোগাযোগব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিক থেকে ব্যাপক পশ্চাৎপদ। দেশের চরাঞ্চলগুলি শিক্ষার দিক থেকে কতটা পিছিয়ে, এখানে তার একটি উদাহরণ দেওয়া যায়; যেমন— চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নদী ভাঙনকবলিত সদর উপজেলার নারায়ণপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলার চর পাঁকা, উজিরপুর ও দুর্লভপুর ইউনিয়নের চরাঞ্চল এখনো অনুন্নত ও অবহেলিত। বিশেষ করে, শিক্ষাক্ষেত্রে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রা সমতলভূমির চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও সংগ্রামমুখর।
এটা চরম বৈষম্যমূলকও বটে। দুর্বিষহ বাস্তবতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে তাদের শিক্ষা অর্জন করতে হয়। নারায়ণপুর, পাঁকা ও দুর্লভপুর (আংশিক) ইউনিয়নে প্রায় ৭০ হাজারেরও অধিক মানুষের বসবাস। কালের পরিক্রমায় অত্র অঞ্চলে শিক্ষায় বিস্তার ঘটেছে বটে, কিন্তু শিক্ষার মান নিম্নমুখী। বর্তমানে এ অঞ্চলে সরকারি/বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা ৪০টির অধিক, শিক্ষক শতাধিক, শিক্ষার্থী কয়েক হাজার। কিন্তু প্রতিযোগিতার এই যুগে তুলনামূলকভাবে শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল। ভালো ও গুণী শিক্ষকের সংখ্যা আরো কম।

প্রায় শতভাগ শিশুর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তির পেছনে দুটি বিষয় প্রধান ভূমিকা রাখে। এক হলো উপবৃত্তির টাকা পাওয়া, দুই স্কুলের ছাত্রসংখ্যা বাড়ানো। চরের প্রাইমারি স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব হলো মাঠে কৃষিকাজে কর্মরত পিতাকে সকালের নাশতা দিয়ে এসে স্কুলে যাওয়া। আর সংসারের জরুরি কাজ সেরে স্কুল বজায় রাখা। এজন্য বাস্তবতা হলো, এ অঞ্চলের প্রাইমারি শিক্ষার মান খারাপ। অধিকাংশ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিজেরাই পড়াশোনার বাইরে। সংসার চালানোর তাগিদে তারা কৃষি বা অন্য কাজে বেশি মনোযোগী। সেই কাজের পাশাপাশি চাকরি বজায় রাখা আর বেতন বাঁচানোর জন্য পরীক্ষা নেওয়া তাদের প্রধান কাজ বললে অত্যুক্তি হয় না। পাশের হার ঠিক রাখার জন্য যে কোনো অসৎ পথ ব্যবহার করা হয়। এজন্য পঞ্চম শ্রেণি পাশ করা বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নিজের নাম-ঠিকানা বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় শতভাগ শুদ্ধভাবে লিখতে পারে না।
তাছাড়া দুর্গম চরাঞ্চলের শিক্ষকদের জন্য অতিরিক্ত কোনো সুযোগ-সুবিধা না থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষকই চেষ্টা-তদবির করে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। এখানে দূর থেকে আসা শিক্ষকদের থাকার কোনো সুব্যবস্থা নেই। এক কথায় চর এলাকা এতই দুর্গম ও এখানকার রাস্তাঘাটের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, সহজে কেউ যাতায়াত করতে পারেন না। উপজেলা শিক্ষা অফিসার বা সহকারী শিক্ষা অফিসার এ চরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কবে পরিদর্শন করেছেন, তা বলা মুশকিল। উপজেলা সদর থেকে এ অঞ্চলে কোনো পরিদর্শক আসার কয়েক দিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। এর ফলে স্কুলের বাস্তবতা আড়ালেই থেকে যায়। বিনা নোটিশে যে কোনো প্রাইমারি স্কুলে দুপুর ১টার পর উপস্থিত হলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কারোর দেখা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ফলে এখানকার প্রাইমারির কোমলমতি শিক্ষার্থীরা মৌলিক অধিকার শিক্ষা অর্জনে বৈষম্য ও অবহেলার শিকার।
উল্লেখ্য, চরাঞ্চলের প্রাইমারির শিক্ষা শেষ করে শিক্ষার্থীদের হাইস্কুলে ভর্তির হার অত্যন্ত কম। প্রায় ৫০ ভাগ শিশু পঞ্চম প্রেণি পাশ করে কোনো রকমে ঠেলেঠুলে। পারিবারিক অভাব-অনাটনের কারণে তারা উপার্জনের দিকে ধাবিত হয়। হাইস্কুলেও ভালো শিক্ষক দূরদূরান্ত থেকে এসে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে চাকরি করতে চান না। এমনকি এ অঞ্চলের যারা ভালো ছাত্র ছিল, তারাও কর্মক্ষেত্রে চরে থাকতে চান না। নদীভাঙনকবলিত এলাকায় শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। বলতে গেলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিজের চেষ্টায় এসএসসি পাশ করে। এরই মধ্যে সিংহভাগ ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যায়। এসএসসি পাশের পর শুরু হয় আরেক লড়াই। চরাঞ্চলে কলেজের সংখ্যা কম। ভালো কলেজ আরো দুর্লভ। কেউ কেউ শহরের আশপাশে স্বল্প খরচে থাকা যায়, এমন হোস্টেল বেছে নেয়। প্রতি মাসের খরচ জোগান দেওয়ার সামর্থ্য বেশির ভাগ পরিবারের নেই। এজন্য বাড়ি থেকে চাল নিয়ে এসে ডাইনিং চালায়। অনেকেই কিছুদিনের জন্য জেলার বাইরে গিয়ে রাজমিস্ত্রি বা ফেরিওয়ালার কাজ করে উপার্জন করে। সেই টাকা দিয়ে পরবর্তী দুই-তিন মাস পড়াশোনা ও ক্লাস করে। আবার অনেকে নিজ গ্রামে কৃষিকাজ করে উপার্জন করার পাশাপাশি কোনোরকমে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। ফলে ডিগ্রি অর্জন হলেও প্রতিযোগিতার এই যুগে যথার্থ শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ে তারা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাদের কর্মক্ষেত্রে।
সারা দেশের চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে দুর্গম এলাকায় শিক্ষকদের জন্য আবাসিক ভবন তৈরি করতে হবে। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। শিক্ষকদের যাতায়াত ভাতাসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে কেউ দায়িত্বকর্মে ফাঁকি দিতে না পারে। শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাঝেমধ্যে বিদ্যালয় পরিদর্শনে যেতে হবে। দূরান্তে অফিসে বসে কাগজপত্র দেখেই পরিদর্শন না করা, বাল্যবিবাহ নিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, জলপথে যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়ন করা, অনিয়ম, দুর্নীতি কঠোর হস্তে দমন করাসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে এই দেশের চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান ও জীবনযাত্রার মান উভয়ই উন্নত করা যেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও সহকারী অধ্যাপক, বিনোদপুর কলেজ, শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ