ভৌগলিক অবস্থান এবং ভূ-প্রকৃতির গঠনশৈলীর কারণে ‘চর’ এই জনপদে অত্যাধিক পরিচিত। আমাদের জাতীয় জীবনেও চরের প্রভাব ও ভূমিকা ব্যাপক। দেশের ছোট—বড় প্রায় সকল নদীতেই রহিয়াছে চরের অস্তিত্ব। এই সকল চরের কোনো কোনোটি স্থায়ী ভূমিতে পরিণত হয়, সেইখানে গড়িয়া উঠে মানববসতি, আবার কোনোটিতে এপারের মানুষ ওপার যাইয়া ঘর বাঁধে। প্রকৃতির রুদ্র আচরণের সহিত যুদ্ধ করিয়াই চরের মাটি কামড়াইয়া তাহারা টিকিয়া থাকে। এই সংস্কৃতি চলিয়া আসিতেছে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। তবে প্রকৃতিকে তাহারা যুদ্ধ করিয়া পরাস্থ করিতে পারিলেও স্বজাতির নিকট তাহারা যেন বড্ড অসহায়! কারণ, দখল সংস্কৃতি। কবি নজরুল তাহার বিখ্যাত গানে লিখিয়াছেন, নদীর একূল ভাঙে, ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা (রে ভাই), এই তো বিধির খেলা। কিন্তু বিধির এই খেলায় যখন মানুষ হস্তক্ষেপ করে তখন তাহা হইয়া উঠে সহিংস।
সম্প্রতি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায় পদ্মায় জাগিয়া উঠা চর দখলকে কেন্দ্র করিয়া দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা আমাদের দৃষ্টিগোচর হইয়াছে। এই সংঘাতে গুলিবিদ্ধ হইয়া এক ব্যক্তি নিহত এবং ১৩ জন আহত হইয়াছেন। বস্তুত, মাঝেমধ্যেই চর দখল এবং ইহা লইয়া সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। নূতন চর জাগিয়া উঠিলেই সেইখানে দখলদাররা হুমড়ি খাইয়া পড়ে, শুরু হয় জবরদখলের প্রতিযাগিতা। প্রাগৈতিহাসিক কাল হইতে অদ্যাবধি এই চরের দখল লইয়া কী পরিমাণ দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুন-খারাবির ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহার কোনো ইয়ত্তা নাই। ইহার কারণ, নূতন চরে না থাকে কোনো সামাজিক নিয়ম কানুন, না থাকে রাষ্ট্রীয় আইনের বালাই! বরং এইখানে বিরাজমান থাকে অনেকটা ‘জোর যাহার মুল্লুক তাহার’ অবস্থা। যাহার লাঠির জোর যত বেশি, তাহার অধিারই সেইখানে আইন হইয়া উঠে।
অতীতে জমিদার-জোতদাররা লাঠিয়াল বাহিনী পুষিত চর দখল এবং তাহাতে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখিবার জন্য। এমনই চর দখলের ঘটনাকে উপজীব্য করিয়া প্রয়াত প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার নারায়ণ ঘোষ নির্মাণ করিয়াছেন তাহার বিখ্যাত ছবি ‘লাঠিয়াল’। তৈরি হইয়াছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের ভূবন বিখ্যাত উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝি। নদী ভাঙনে একদা সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষ নূতন চরে নূতন করিয়া বসতি স্থাপনের স্বপ্ন দেখিলেও দখলবাজদের দৌরাত্মের কারণে তাহাদের স্বপ্ন স্বপ্নই থাকিয়া যায়।
কীভাবে দখল হইয়া যায় এই চর? চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের ভাষ্যানুযায়ী, নদীতে চর জাগিয়া উঠার খবর পাওয়ামাত্র বাঁশের খুটিঁ গাড়িয়া নিশানা দিয়া রাখে দখলদাররা। ইহার পর চরের বুকে তুলিয়া দেওয়া হয় অতি উচ্চ টং ঘর। ইহার ফলে এক অঘোষিত আইন হইয়া যায়! এক একটি টং ঘরের আশপাশের বিস্তীর্ণ জমির মাঝে কাহারো প্রবেশের অনুমতি থাকে না। আর এই সীমানার মধ্যে গরু-মহিষ ছাড়িয়া দিলেই চরটি সম্পূর্ণরূপে দখলে চলিয়া আসে! অতঃপর চরটি পূর্বপুরুষের সম্পত্তি কিংবা ঐ ভূমি সরকারের নিকট হইতে লিজ নেওয়া হইয়াছে বলিয়া প্রচার চালায় দখলবাজ মহল। কতিপয় ক্ষেত্রে আদালতে মামলা ঠুকাইয়া দেওয়া হয়, যাহার ফলে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাহারা চরের মালিক বনিয়া যাওয়ার অবকাশ পায়।
দেশের অর্থনীতিতে চরাঞ্চলের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নহে। তথাপি চরবাসীদের উন্নয়নে দৃশ্যমান কাঙ্ক্ষিত কোনো পরিবর্তন নাই। আইন করা হইয়াছে যে, যেই জায়গায় চর জাগিয়া উঠিবে, নদী ভাঙনের পূর্বে সেই জায়গার মালিক যিনি বা যাহারা ছিলেন, পূর্বের দালিল দস্তাবেজ দেখিয়া তাহা নিরূপন করিয়া মালিকানা বুঝাইয়া দিতে হইবে। এই সকল কাজ তদারকির জন্য ‘চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্ট ব্রি্রজিংয়ের (সিডিএসপি-বি) ন্যায় উদ্যোগও গ্রহণ করা হইয়াছে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী, যখন কোনো জমি নদীতে বিলীন হইয়া যায়, তখন তাহাকে ‘শিকস্তি’ জমির অন্তভুর্ক্ত করা হয় এবং ইহার খাজনা নেওয়া বন্ধ থাকে। ইহার পর যদি ৩০ বৎসরের মধ্যে ঐ জমির চর জাগিয়া উঠে, তখন প্রকৃত মালিকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ঐ ‘পোয়স্তি’ জমিকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এই সুস্পষ্ট আইন সত্বেও আজিও কেন চর দখল লইয়া মানুষকে প্রাণ হরাইতে হয় তাহা কর্তপক্ষকে ভাবিয়া উদ্যোগ লইতে হইবে।