বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছে, যেখানে দেশের বর্তমান জনসংখ্যা এক অসাধারণ সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। দেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ তরুণ এবং ১৫-৫০ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী প্রায় ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে, জনসংখ্যাগত সুবিধা (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) তথা ১৫-৬৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী যাদের ওপর নির্ভর করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, তারা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ। এই জনমিতিক সুবিধার যুগ শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে, যা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল। তবে ২০২১ সাল থেকে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অনুপাত ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে, যা ৬৮ শতাংশ থেকে ক্রমশ কমছে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৪০ সালের পর এই সুবিধা দ্রুত ফুরিয়ে যাবে এবং নির্ভরশীল জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে।
এই পরিস্থিতিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল শক্তিতে রূপান্তর করা বাংলাদেশের জন্য একটি জরুরি চ্যালেঞ্জ। দক্ষতা উন্নয়ন, মানসম্মত শিক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এবং উদ্যোক্তা বিকাশের মাধ্যমে এই সুযোগকে কাজে লাগানো সম্ভব। উন্নত দেশগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার, যা তরুণদের আন্দোলনের ফল, এই সুযোগকে কাজে লাগাতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করা যায়। এখনই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার, কারণ এই সুযোগ একবারই আসে, এবার তা হারিয়ে গেলে তা আর ফিরে আসবে না।
বর্তমানে জনসংখ্যার মিডিয়ান এইজ তথা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর গড় বয়স ২৫.৭ বছর, যা দেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী কর্মক্ষম হওয়া অর্থনীতির জন্য একটি বিরাট সুযোগ। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, যেসব দেশ জনমিতিক সুবিধাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছে, তারা টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, এবং সিঙ্গাপুরের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে অনুকরণীয়। এই দেশগুলো তাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করেছে এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে উৎপাদনশীল খাতে তাদের সম্পৃক্ত করেছে।
তবে এই সুবিধা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত নীতি ও কৌশল। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য উচ্চমানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যা তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়াবে। একইসঙ্গে, শিল্পখাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা জরুরি। তরুণদের জন্য মানসম্মত চাকরির বাজার তৈরি, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের উন্নয়ন এবং প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারে। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এই সুবিধা হারিয়ে যাবে, এবং তা পরবর্তীতে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা এবং কর্মসংস্থানে যুক্ত করার মাধ্যমে এই সুযোগকে কাজে লাগানো বর্তমান সময়ের এক বড় চ্যালেঞ্জ।
জনসংখ্যাগত সুবিধার পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে দেশের তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ, উৎপাদনশীল এবং উদ্ভাবনী জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা একটি চ্যালেঞ্জ হলেও, সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে তা অর্জন সম্ভব। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য সম্ভাব্য কার্যকর উপায়গুলো তুলে ধরছি।
প্রথমত, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন সর্বাগ্রে বিবেচ্য। তরুণদের কর্মক্ষম করে তুলতে মানসম্মত শিক্ষা এবং ডিজিটাল ও কারিগরি প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। দেশে শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে তা কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, বরং বাস্তব জীবনে প্রাসঙ্গিক দক্ষতা প্রদান করতে পারে। কারিগরি শিক্ষার প্রসার এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে তরুণদের হাতে-কলমে কাজ শেখানোর সুযোগ দিতে হবে এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, উদ্যোক্তা সৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরি তরুণদের সৃজনশীলতা ও আত্মনির্ভরশীলতার চর্চা বৃদ্ধি করতে পারে। সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। ব্যবসা শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় আইন-কানুনও সহজ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষিভিত্তিক প্রযুক্তি, ই-কমার্স এবং পরিষেবা খাত তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।
তৃতীয়ত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পখাতের প্রসার জরুরি। নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা গেলে তা তরুণদের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। রপ্তানিমুখী উৎপাদন বাড়ানো এবং নতুন শিল্প খাতে প্রযুক্তি নির্ভর কর্মসংস্থান তৈরি তরুণ প্রজন্মকে কর্মমুখী করতে সহায়ক হবে। দেশীয় শিল্পের বিকাশের জন্য সরকারকে নীতি সহায়তা প্রদান করতে হবে, যা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করবে।
চতুর্থত দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি তথা তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত জরুরি। নারীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, তাদের দক্ষতা উন্নয়ন, এবং তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া উন্নত স্বাস্থ্যসেবা একটি জনগোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অন্যতম পূর্বশর্ত। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকে। দীর্ঘমেয়াদে একটি স্বাস্থ্যবান কর্মশক্তি অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম।
পঞ্চমত ২০৪০ সালের পর থেকে দেশের নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে। পাশাপাশি, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আগমন এবং প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন নানা নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ এনে দেবে। এমন প্রেক্ষাপটে বর্তমান কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দক্ষ ও উৎপাদনশীল করে তোলা জাতীয় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত জরুরি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব মোকাবিলায় তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, এবং ই-কমার্সের মতো খাতগুলোতে দক্ষতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জনের জন্য কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে উন্নত প্রশিক্ষণ ও উদ্ভাবনী চর্চার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
বর্তমানে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি। তাদের সর্বোচ্চ দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে মানসম্মত শিক্ষা, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা অপরিহার্য। যদি এই সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বেকারত্ব, অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সামনে এই সুযোগ একবারই এসেছে। যথাযথ নীতি, পরিকল্পনা, এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে এটি কাজে লাগাতে না পারলে, ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। তাই এখনই সময় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করার।
তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের ফসল বর্তমান সরকার, তাই তাদের জন্য এক বিশেষ দায়িত্ব হলো দেশের জনসংখ্যাগত এই সুবিধাকে কাজে লাগানো। তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মক্ষমতাকে সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যবহার করতে এখনই দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই লক্ষ্য অর্জনে প্রথম ধাপ হলো গবেষণা—ভিত্তিক নীতি নির্ধারণ। জনসংখ্যাগত সুবিধার প্রকৃত চাহিদা ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করার জন্য ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে এমন নীতি ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে তরুণদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা জরুরি। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্ব তরুণদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও উৎপাদনশীল খাতে সরকারি—বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ তরুণদের কর্মক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করতে সহায়ক হবে।
সর্বোপরি, তরুণদের উদ্দেশ্যে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। স্টার্টআপ তহবিল, সহজ শর্তে ঋণ, এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের উদ্ভাবনী চর্চাকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। পাশাপাশি, উন্নত ক্যারিয়ার পরামর্শ এবং কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা তরুণদের আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করবে। এই উদ্যোগগুলো তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে এবং জনমিতিক সুবিধাকে সফলভাবে কাজে লাগানোর পথ সুগম করবে।
জনসংখ্যাগত সুবিধা দেশের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ, যা সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং কৌশলের মাধ্যমে কাজে লাগানো সম্ভব। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত ও দক্ষ করে তোলা, উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীদের সম্পৃক্ত করা এবং স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন—এই সকল পদক্ষেপ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাবিকাঠি হতে পারে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক স্থিতিশীলতা, এবং উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো অপরিহার্য। সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, এই সুযোগ চিরতরে হারিয়ে যাবে। তাই এখনই সময় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের পথে সম্পৃক্ত করার। এটি শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং সমগ্র জাতির একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা হওয়া উচিত। এখন সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার, ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য আজকের কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার। কিন্তু যেই তরুণরা আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন সম্ভাবনা ও স্বপ্ন জাগাল, তাদের জন্য সংস্কারমূলক কর্মসূচিতে কী থাকছে? তারা রক্ত দিয়ে আবার নিরাশ হবে না তো?
লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়