ডেঙ্গু বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের জন্য এক জটিল স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষা মৌসুমে এর প্রকোপ বৃদ্ধি পেলেও বর্তমানে শীতকালেও এ রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রতি বছর অগণিত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এতো জনবহুল দেশে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে টেকসই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এই সমস্যা দিনদিন ভয়াবহ রূপ ধারণ করতেই থাকবে। এক্ষেত্রে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনই হতে পারে এই রোগ প্রতিরোধের কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ২০০০ সাল হতে শুরু হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর প্রকোপ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় তিন লক্ষাধিক, যা এর ভয়াবহতা এবং আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতা স্পষ্ট করে তোলে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এডিস মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধে যথাযথ পরিকল্পনার অভাব, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং সচেতনতার অভাব এর মূল কারণ। তদুপরি, ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন না থাকায় এই রোগের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশ্ব জুড়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ইতিমধ্যে দুটি ভ্যাকসিন, ডেংভ্যাকসিয়া এবং কিউডেঙ্গা আংশিকভাবে কার্যকর প্রমাণিতও হয়েছে। ডেংভ্যাকসিয়া টিকা প্রাথমিকভাবে ফ্রান্সে তৈরি হলেও এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটি কেবল ৯ হতে ১৬ বছর বয়সি ডেঙ্গুতে আগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কার্যকর। আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত না হলে এ টিকা প্রয়োগে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে, জাপানের তৈরি কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন তুলনামূলকভাবে অধিক কার্যকর। এটা ছয় হতে ৪৫ বছর বয়সি যে কোনো ব্যক্তিকে প্রদান করা যেতে পারে।
কিউডেঙ্গা ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধেই কার্যকর হওয়ার প্রমাণ রেখেছে এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে অতি নগণ্য। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে—যেখানে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যুহার পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক, ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের গুরুত্ব অপরিসীম। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনটি বেশ কার্যকর বলে উল্লেখ করেছেন। ইন্দোনেশিয়া ও ব্রাজিলের মতো ডেঙ্গু-প্রবণ দেশগুলোতে এটি ইতিমধ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে এবং সাফল্য অর্জন করছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিনটি দ্রুত কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। যারা ডেঙ্গুর প্রতি অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ—বিশেষত শিশু-কিশোরগণ, তাদের সুরক্ষায় এই ভ্যাকসিন ব্যবহার করা অতি প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ডেঙ্গু ভ্যাকসিন উন্নয়নে নিজস্ব গবেষণা কার্যক্রমে অগ্রসর হয়েছে বলে আমরা অবগত আছি। আইসিডিডিআর,বির সহযোগিতায় টেট্রাভেলেন্ট নামক একটি টিকার গবেষণা কার্যক্রম সফলতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এটা সফল হলে দেশে স্বল্পব্যয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব হবে। তবে এর বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য এখনো সময় প্রয়োজন। আর তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন আনার উদ্যোগ গ্রহণ করে তার কার্যকারিতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
ডেঙ্গু প্রতিরোধের ক্ষেত্রে একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—ভ্যাকসিন সহজপ্রাপ্য হলে এবং এ থেকে টেকসই ফলাফল পেলেও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই। সবাইকে এই কথা মাথায় রাখতে হবে, হতে হবে সতর্ক ও সজাগ। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, স্থানীয় সরকার এবং সাধারণ জনগণকেও এতে সম্পৃক্ত করতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং নিয়মিত মশা নির্মূল কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে। এডিস মশার বিস্তার রোধে সরকার এবং জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতেই হবে। তা হলেই কেবল আমরা ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতা হতে মুক্তি পাব। বলা যায়, বাংলাদেশকে ডেঙ্গুমুক্ত করতে ভ্যাকসিন, জনসচেতনতা এবং মশা নির্মূলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অতীব প্রয়োজন।