আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মহামতি সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘যুবকেরা আমাদের আশা, তাদের মধ্যে নতুন চিন্তাধারা, নতুন শক্তি এবং নতুন উদ্যম রয়েছে।’ পবিত্র কুরআন শরিফের সূরা আর-রুম আয়াত ৫৪-এ বলা হয়েছে, ‘মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেন দুর্বল অবস্থা হতে, এরপর তিনি দেন শক্তি; শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য।’ এখানে মহান আল্লাহ তা’আলা স্বীয় অসীম ক্ষমতার আরো একটি পরিপূর্ণতার কথা বর্ণনা করেছেন; আর তা হলো, ‘মানুষ সৃষ্টির বিভিন্ন স্তর। দুর্বল অবস্থার অর্থ হলো, শিশু অবস্থা; আর শক্তির অর্থ হলো যৌবনকাল, যাতে দৈহিক ও জ্ঞান-বুদ্ধির শক্তি পরিপূর্ণতা লাভ করে থাকে।
অর্থাৎ, শক্তির স্তরটি-ই তরুণদের জন্য উৎসারিত। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা তরুণদের নিকট শক্তি অর্পণ করেছেন। প্রকৃত অর্থে পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি যুগে তরুণ প্রজন্মই নতুন চিন্তাধারা, নতুন আন্দোলন এবং নতুন পরিবর্তনের সূচনা করেছে। বাংলাদেশেও তরুণদের উদ্যম, সৃজনশীলতা এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা সমাজকে নতুন রূপ দিয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনেও তরুণদের অবদান অপরিসীম। সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন দায়িত্বশীল তরুণ নেতৃত্ব বলেছেন যে, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের ফলস্বরূপ আগামী দুই দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে তরুণদের প্রভাব অব্যাহত থাকবে।
আমরা মনে করি, তরুণদের কেবল ‘প্রভাব’ থাকবে, তা-ই নয়; বরং বলতে হয়, তরুণরাই তাদের চিন্তাভাবনা, ধ্যান-ধারণা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজকে ব্যাপকভাবে পুনর্নির্মাণ করবে। নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন বলেছেন, ‘আমি শিখেছি যে, বীরত্ব হলো প্রতিদিন উঠে দাঁড়ানো।’ তরুণরাই প্রতিদিন উঠে দাঁড়াতে পারে, আমাদের এই বীরত্ব শেখাতে পারে। তরুণদের দৈনন্দিন জীবনে যেসব চ্যালেঞ্জ আসে, তা মোকাবিলা করতে তারা পিছু হটে না। এটা যুগে যুগে সারা বিশ্বেরই চিত্র।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার কপালকুণ্ডলায় লিখেছেন যে, ‘উপকূলে আশ্রয় নেওয়া সকল নৌকাযাত্রীর হিতার্থে নায়ক নবকুমার কাঠ আনিতে গিয়াছিল। এইদিকে জোয়ার চলিয়া আসায় দ্রুত নৌকা ছাড়িতে হইবে বিধায় সকলেই উদ্গ্রীব হইয়া গেল কখন নবকুমার আসিবে। কিন্তু নবকুমার সহসা আসে না। তখন বাকি সকলে মিলিয়া নিজেদের প্রবোধ দিল ‘নবকুমারকে ব্যাঘ্রে হত্যা করিয়াছে। তাহাই সম্ভব। তবে এত ক্লেশ-স্বীকার কি জন্য?’ তার নবকুমারকে সেখানে একাকী রেখেই নৌকা নিয়ে চলে গেল। আর এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পেলাম সেই বিখ্যাত উক্তি—‘তুমি অধম তাই বলে আমি উত্তম হব না কেন?’
সবুজের অভিযানে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন—‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,/ও রে সবুজ, ওরে অবুঝ,/ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’; তেমনি নবীন আর তরুণরাই চিরকাল আমাদের হতাশার সলতেতে আশার আলো জ্বালিয়ে দিয়ে আসছে।
কয়েক বছর আগে ইংল্যান্ডে ৮২ বৎসর বয়সি ব্রিটিশ নারীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ২০ বছর বয়সি এক ব্রিটিশ মুসলিম তরুণ মারা যান। তিনি মারা গেছেন বটে, তবে নিজের বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। সেসময় বাংলাদেশে নারায়ণগঞ্জে বখাটেদের কবল হতে এক দম্পতিকে রক্ষা করতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে সানজিদ দেওয়ান নামে এক তরুণ নিহত হন। এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনা বলে দেয়, এক মানুষের প্রাণ রক্ষার্থেও তরুণরা নিজেদের বিপন্ন করতে দ্বিধা করেন না। অর্থাৎ তারা সাহসী, দায়িত্ববোধসম্পন্ন এবং ন্যায়ের পক্ষে।
বস্তুত, তরুণদের হাতেই জাতির ভবিষ্যৎ। তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে, তাদেরকে সুযোগ দিতে হবে। সব ক্ষেত্রে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য একটি সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলাটাই উন্নত রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। সুতরাং, আমাদেরও সেই বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে হবে। এজন্য তরুণদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই বঙ্গের তরুণ তারকারা জ্বলে উঠবেন বিশ্বগগনে! কেবল প্রভাব নয়, তরুণরাই গড়ে তুলবে নতুন পৃথিবী।