বিশ্বায়নের এই যুগে পাসপোর্টের কালো-নীল মলাট এখন শুধু ভ্রমণের অনুমতিপত্র নয়, বরং জীবনের বিকল্প রুটম্যাপ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো এক দোদুল্যমান অবস্থায় আছে, যেখানে দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা এক নতুন বাস্তবতাকে সামনে আনছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাতৃভূমির প্রতি দায়বদ্ধতা যেমন অপরিসীম, তেমনি তাদের বিদেশে অর্জিত সক্ষমতা ও সম্পদ বাংলাদেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার এক অবিশ্বাস্য সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের প্রসঙ্গ এখন আর নিছক আইনি বা প্রবাসী সংযোগের ইস্যু নয়, বরং এটি পরিণত হয়েছে একটি বহুমাত্রিক জাতীয় বিতর্কে।
দ্বৈত নাগরিকত্ব বলতে সেই অবস্থাকে বোঝায়, যেখানে একজন ব্যক্তি একই সময়ে দুটি দেশের নাগরিকত্বের অধিকারী হন। এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি দুটি দেশের আইন, রাজনৈতিক সেবা, সামাজিক সুবিধা এবং নাগরিক অধিকার অর্জন করেন। এই অবস্থায়, ঐ ব্যক্তি দুই দেশের আইনগত অধিকার ও দায়বদ্ধতার মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ রাখেনি, কারণ তত্কালীন রাষ্ট্রনেতারা রাষ্ট্রীয় পরিচয়কে একক ও অখণ্ড রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স’ সংশোধনের মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকত্বকে স্বীকৃতি দেয়। এই আইনের আওতায় বাংলাদেশের নাগরিকরা নিজ দেশের নাগরিকত্ব রেখে অন্য ৫৭টি দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ পান। ২০২৩ সালে দ্বৈত নাগরিকত্বের পরিসর আরো বাড়ানো হয় এবং নতুন আরো ৪৪টি রাষ্ট্র যুক্ত করা হয়। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকদের ১০১টি দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এর পেছনে মূল লক্ষ্য ছিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং তাদের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করা। তবে বর্তমান সময়ে দ্বৈত নাগরিকত্ব বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে, নাকি এক নীরব সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে—সেটাই এখন সবচেয়ে বেশি ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারি হিসাব মতে, বাংলাদেশি দ্বৈত নাগরিকত্বের সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়েছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় বাংলাদেশ থেকে সনদধারী দ্বৈত নাগরিকের সংখ্যা ৩৪ হাজারেরও বেশি। এর ফলে বিদেশে বাংলাদেশি ডায়াসপোরার ক্রমবর্ধমান শক্তি যেমন দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে অবদান রাখছে, তেমনি রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও তাদের প্রভাব লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উত্স। দ্বৈত নাগরিকত্বধারীরা সরাসরি বিনিয়োগ, স্টার্টআপ ফান্ডিং এবং রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখছে। যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালোর দিকে এগোচ্ছে। অর্থনীতির এই সুবিধাগুলো নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, দ্বৈত নাগরিকত্বধারীরা তাদের গ্রহণ করা নতুন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। তবে দ্বৈত নাগরিকত্ব শুধু আশার বার্তা বহন করে না; এটি রাষ্ট্রীয় পরিচয়, নিরাপত্তা এবং আস্থার সংকটও তৈরি করতে পারে। কেননা দ্বৈত নাগরিকত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হুমকি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং আর্থসামাজিক বৈষম্য জড়িয়ে থাকে। যা দেশের ভাবমূর্তিকে পুরো বিশ্বের সামনে নষ্ট করতে পারে।
দ্বৈত নাগরিকত্ব বাংলাদেশকে দ্বিমুখী পথে দাঁড় করিয়েছে। একদিকে উন্নয়ন ও বৈশ্বিক সংযোগের অবারিত সম্ভাবনা, অন্যদিকে জাতীয় পরিচয় ও নিরাপত্তার সূক্ষ্ম সংকট। এমন অবস্থায় বাংলাদেশকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবাহ বজায় থাকবে, অথচ জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অক্ষুণ্ন থাকবে। সেক্ষেত্রে বাছাই করা নাগরিকত্ব নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে। এ নীতির মাধ্যমে সব দেশের প্রবাসীদের দ্বৈত নাগরিকত্ব দেওয়ার পরিবর্তে নির্দিষ্ট দেশভিত্তিক ও পেশাভিত্তিক ও অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সক্ষমদের বিবেচনা করতে হবে। দ্বৈত নাগরিক প্রার্থীদের পরিচয় যাচাইয়ের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আধুনিক বায়োমেট্রিক ও ডিজিটাল ডাটাবেজের মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকদের সুনির্দিষ্ট পরিচয় ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। এতে অপরাধমূলক কাজ রোধ করা সহজ হবে। যারা অপরাধে লিপ্ত হবেন, তাদের নাগরিকত্ব বাতিল এবং তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। দ্বৈত নাগরিকদের দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতার মাপকাঠি আইনিভাবে স্বীকৃতি এবং বাস্তবায়নের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকদের অবশ্যই আয়কর পরিশোধ, ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং জাতীয় সংকটে সহায়তা করার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ, পরিকল্পিত ও যুগান্তকারী ব্যবস্থার মাধ্যমে এটি হয়ে উঠতে পারে উন্নয়নের মহাসেতু, যা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে আরো সমৃদ্ধ করবে এবং দেশকে পুরো বিশ্বের সামনে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ