আমৃত্যু দুঃখের পারাবারে নিমজ্জিত থেকেও দুঃখ যাকে দুঃখ দিতে পারেনি, যিনি বেদনাকে পরম আপন করে নান্দনিকতায় রূপ দিয়েছেন, কষ্টকে মহান করে তুলেছেন কবিতার কারুকাজে, তিনি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র হেলাল হাফিজ। এক মানবীর দেয়া কষ্ট নিয়ে তিনি আজীবন নিঃসঙ্গতা আর কবিতার সঙ্গে করেছেন ঘর—সংসার। তবু সেই মানবীর প্রতি রাখেননি কোনো অভিযোগ, কোনো অনুযোগ কিংবা আক্ষেপ। নষ্ট জীবনের কষ্ট নিয়ে তাকেই ভালোবেসে গেলেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। ভালোবাসার এমন দৃষ্টান্ত যে জগতে একেবারেই বিরল!
কবি হতে হলে দুঃখ প্রয়োজন। হেলাল সেই মহামূল্যবান উপহার পেয়েছেন হেলেনের কাছ থেকে। তার বিরহের আগুনের পরশেই হেলাল বাজিয়েছেন কবিতার তানপুরা। এই যে বিরহের অনলে পুড়িয়ে হেলেন কবি করে তুললেন হেলালকে, এ-ও তো এক ধরণের ঋণ। অপরিশোধ্য এই ঋণের দায় হেলালকে তাড়া করে বেড়াতো। তাই হয়তো প্রতিদান দেয়ার চেষ্টায় তিনি তাঁর কবিতায় হেলেনকে দিয়েছেন অমরত্ব। জীবনের সবটুকু বেদনায় অর্জিত জলে জ্বাললেন আগুন। ছড়িয়ে পড়লো তা। এ আগুন যেন শুধু কবির একার নয়, পৃথিবীর হাজারো ব্যর্থ কিংবা অব্যর্থ প্রেমিক আপন করে নিয়েছে এই আগুন।
কবিতা যাদের পরম আশ্রয়, যারা কাব্যে আহার করে, লিখে নিঃশ্বাস নেয়, তারা জানেন লেখা বন্ধ রাখার বেদনা। মাথায় ঘুরতে থাকা ছন্দ খাতায় না সাজানো কবির জন্য প্রায় অসম্ভব, আর জনপ্রিয়তা হাতের নাগালে আসার পরে তো তা একেবারেই অসম্ভব। তবুও জনপ্রিয়তার স্রোতে গা ভাসিয়ে একের পর এক কাব্য বিক্রি করা থেকে নিজেকে আটকে রেখেছেন হেলাল।
চাইলেই হয়তো লিখতে পারতেন, বই নামক পণ্য দিয়ে ব্যবসা চালাতে পারতেন নির্দ্বিধায়। ব্যবসার সেই বাজার সৃষ্টি হওয়ার পরেও সেখান থেকে নীরবে দূরে সরে গিয়েছেন শিল্পের মান রক্ষার জন্য। কিংবা লিখলে হয়তো শিল্পের ক্ষতি হতো না, তবু জীবনের সবটুকু বেদনা দিয়ে লেখা কবিতাগুলোকে যে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
তাই তো ”যে জলে আগুন জ্বলে” প্রকাশিত হওয়ার পরে তিনি চলে গেলেন নির্জনতায়। এর ৩৪ বছর পরে ফিরে এলেন পাঠকদের মাঝে, হয়তো পাঠকের আকাঙ্খার প্রতিদান দিতে, কিংবা না লেখার বেদনা সইতে না পেরে। ফিরে এলেন মাত্র ৩৪টি কবিতা নিয়ে। এরপর আর ফিরলেন না। ফেরার ইচ্ছে ছিল কিনা, তাও জানা গেল না। পাঠকেরা ভাবতেই পারে যে কবি তাদের বঞ্চিত করেছেন দারুণভাবে। তবুও কবিতার জন্যই হেলাল ব্যয় করেছেন তার সমগ্র জীবন, এও তো অস্বীকার করা যায় না।
বস্তুত, কবিদের মৃত্যু হয় পুনর্জন্মের প্রয়োজনে। মৃত্যুই যেন তাদের নিয়ে যায় অমরত্বের জগতে। হেলাল আর ফিরবেন না এই জগতে। অপূর্ণতার বেদনা নিয়ে, অভিমান নিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তবু থেকে যাবেন হাজারো প্রেমিকের প্রণয়সিক্ত হৃদয়ে। তিনি থেকে যাবেন চিরকাল অমরত্বের নান্দনিক জগতে।
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়