ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন আমেরিকার ‘প্রেসিডেন্ট দ্য ইলেক্ট’। খুব বেশি দিনের কথা নয়— চলতি বছরের শুরুর দিকে যখন তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার জন্য তাকে কোর্টে হাজির করা হয়, তখন একাধিকবার তাকে বিভিন্নভাবে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। দ্য নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় এরিক ল্যাচের এ সংক্রান্ত এক কলামের শিরোনাম হলো : Donald Trump is being ritually humiliated in court. অর্থাৎ, ডোনাল্ড ট্রাম্প আদালতে রীতিমত অপমানিত হচ্ছেন। এ বছরের এপ্রিলে যখন আদালত কক্ষে তার বিচার চলছিল, তখন অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে কক্ষের তাপমাত্রা এক বা দুই ডিগ্রি বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হলে তার প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হয়।
কেউই আইনের উর্ধ্বে নয়— হোক তিনি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রি-এমপি বা একজন দারোয়ান। কিন্তু কোর্টে আসামীকে লক্ষ করে হাতাহাতি করা, গালি-গালাজ করা, আক্রমণাত্মক অঙ্গভঙ্গি করা; এমনকি ভ্রম্নকুটি দেখানো বা বিড়বিড় করা হবে কেন? এটা কী ধরনের সংস্কৃতি? আমেরিকার মতো উন্নত দেশ বলেই সেখানে বিচারক আসামীর প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের কারণে তিরস্কার বা জরিমানার ব্যবস্থা করেছেন। আর ট্রাম্পের ভাগ্য ভালো যে, নিউইয়র্ক আদালতের শুনানির সময় ক্যামেরা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি। নতুবা মব ট্রায়ালের পাশাপাশি মিডিয়া ট্রায়ালেও তিনি আরেক দফা বিপর্যস্ত হতেন। একবার কোর্ট রুমের দরজা প্রায় তার গায়ের ওপর এসে লেগে যাচ্ছিল, ঐ ঘটনা নিয়েও দেশটিতে তুমুল সমালোচনা দেখা দেয়।
আমেরিকার মতো উন্নত দেশের আদালতে আসামির প্রতি কতটা সদয় ও যৌক্তিক আচরণ করা হয়, তা ওপরের ঘটনা হতে সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কোর্ট-কাচারিতে বিশেষত রাজনীতিবিদরা অহরহ অপমানিত ও অপদস্থ হচ্ছেন। তাদের কোর্টে হাজির করার সময় এমনভাবে লাইন দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যে, তা দেখে তারা তো বটেই, এমনকি এটা তাদের আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্যও মনোবেদনার কারণ হয়ে উঠছে। তারা কোনো অন্যায়-অনিয়ম বা অপরাধ করলে আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি হবে, এটাই কাম্য। কিন্তু বিচারের আগে বিচার করা কিংবা তাদের মান-সম্মানে আঘাত করা কোনো বিবেকবান মানুষের কাম্য হতে পারে না। এটা কারোও জন্যই মঙ্গলজনক নয়।
মিডিয়া ট্রায়ালের ব্যাপারে এসব দেশের অনেক মানুষই আজ সচেতন। কিন্তু মব ট্রায়ালের কথা বলতে গেলে কোনো আলোচনাতেই নেই। রাজনীতিবিদদের কোর্টে উপস্থিত করার সময় তিরস্কার বা কটুক্তি করা এমনকি শারিরীকভাবে লাঞ্ছনার যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, ন্যায়বিচারের স্বার্থেই তার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা প্রয়োজন। একসময়ের জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া দরকার। কেননা, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আজ যাদের গ্রেফতার ও বিচার করা হচ্ছে, আগামীকালই যে তারা আবার ক্ষমতায় এসে আজকের ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে একইভাবে অন্যায় আচরণ করবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া সেই ব্রিটিশ আমলেও রাজবন্দীদের প্রতি সদাচরণ করা হয় এবং জেলে ডিভিশন প্রদানসহ বিশেষ সম্মানের সাথে তাদের রাখা হয়। কিন্তু উন্নয়নশীল অনেক দেশে এখন রাজনীতিবিদদের সেই রাজবন্দীর মর্যাদা যেমন সঠিকভাবে দেওয়া হয় না, তেমনি তাদের সাথে চোর-ডাকাত কিংবা দাগি খুনির মতো আচরণ করা হয়, যা খুবই দুঃখজনক। এই কথা আমরা এর আগেও লিখেছি একাধিকবার। কিন্তু এসব দেশে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন যে আসবে, তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
কোনো কোনো দেশে ক্ষুব্ধ জনতা কর্তৃক মানুষকে হেনস্তা বা হামলার ঘটনা প্রায়শ ঘটছে। অর্থাৎ, মব ট্রায়াল একদিকে যেমন কোর্টের বাইরে চলছে, তেমনি কোর্টের ভেতরেও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া বা শারিরীক-মানসিকভাবে নাজেহাল করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যেই প্রক্রিয়ায় হোক, বিচারাঙ্গনের এই মব ট্রায়াল অনাকাঙিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত।