রাজনীতিতে গ্রাচো মার্কসের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে— ‘রাজনীতি হলো সমস্যার অনুসন্ধান করা, সকল জায়গায় এর খোঁজ করা এবং এর ভুল নির্ণয় করার শিল্প।’ এই উক্তি আমাদের শেখায় যে, রাজনীতির মূল কাজ হলো সমস্যার সমাধান; দোষারোপ করে সময় নষ্ট করা নয়; কিন্তু অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে প্রতিহিংসার সর্প সর্বদা হিস হিস করতে থাকে। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘প্রতিহিংসা পোষণ করে রাখলে তা আপনার আত্মাকে বিষাক্ত করে তুলবে।’ মানবহৃদয়ের সবচাইতে নোংরা ও ক্ষতিকর কাজ হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, অমঙ্গল কামনা, পারস্পরিক শত্রুতা। এইগুলোর উপস্থিতি হৃদয়কে কলুষিত করে এবং সর্বোপরি অন্যান্য নেক আমল নষ্ট করে দেয়। হাদিসে বলা আছে-‘হিংসা, বিদ্বেষ মানুষের সকল নেক কর্ম ও ধর্ম ধ্বংস করে দেয়।’ জুবাইর ইবনুল আউআম (রা.) বলেন, ‘রসুলুল্লাহ (স.) বলিয়াছেন, পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলির ব্যাধি তোমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হইয়াছে : হিংসা ও বিদ্বেষ।’ অর্থাৎ, হিংসা ও বিদ্বেষ একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেয়।
উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো কোনো দেশে যারা যখন ক্ষমতায় আসীন হন, তারা অতীতের শাসকদের ভুলত্রুটির ফিরিস্তি নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, সে সকল দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলোর প্রতি মনোযোগ ও দৃষ্টি আড়াল হয়ে যায়! তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কয়েক দশক পরপর বড় ধরনের ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। সেই পালাবদল অধিকাংশ সময়ই কোনো সাধারণ পালাবদল নয়। যারা তখন ক্ষমতার উত্তাপে উষ্ণ থাকেন, তারা এই ধরনের পালাবদলকে ভূষিত করেন ‘ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন’ হিসেবে। তবে ত্রিকালদর্শী জ্ঞানীর নিকট প্রশ্ন জাগে-পালাবদল হলেই কি সত্যিই ‘পরিবর্তন’ হয়? ‘পরিবর্তন হয়েছে’ বলার পরও যদি অতীতের মতোই প্রায় সকল ধরনের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হয়, একই ঢঙে ও সুরে সমালোচনা করা হয়, তাহলে পরিবর্তনটা আসলে হইল কোথায়? একইভাবে মামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ কিংবা অপব্যবহার, অসহিষ্ণুতার মাত্রা যদি অতীতের মতোই তীব্র ও তীক্ষ্ণ হয়, তাহলে সেখানে পরিবর্তনটা কোথায় রইল? একটি লিডারশিপ যখন ব্যর্থ হয়, তখন বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ, যারা ক্ষমতার অংশীদার ছিলেন না, তাদের অনেকেই দুর্ভোগ-নির্যাতনের শিকার হতে থাকেন; তখন ‘পরিবর্তন’ কথাটার কী অর্থ দাঁড়ায়? দেখা যায়, এই ধরনের পালাবদলে শহর হতে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্রই মিথ্যা মামলার মচ্ছব চলতে থাকে। আর চলতে থাকে ‘ভেঙে দাও’, ‘গুঁড়িয়ে দাও’, ‘ধ্বংস করো’, ‘আগুন জ্বালো’র মতো পূর্বতন জ্বালাময়ী ভাষণ কিংবা স্লোগান। এটাই যদি চলতে থাকে, তাহলে তো ভাষারও কোনো পরিবর্তনই হলো না! অতীতের মতোই প্রচার-প্রচারণায় লাগামহীন গলাবাজি করলেই যদি ‘পরিবর্তন’ হয়ে যায়, তখন তৃতীয় বিশ্বের এই সকল দেশে পালাবদলের পর ক্ষেত্রবিশেষে অ্যানার্কি হ্রাসের পরিবর্তে বহুক্ষেত্রে বেড়ে যায়।
সুতরাং, উন্নয়নশীল বিশ্বে যারা পালাবদলের পর কথায় কথায় ‘পরিবর্তন’-‘পরিবর্তন’ বলছেন, তাদের বলা উচিত— পরিবর্তনটি আসলে কোথায়? স্পষ্ট করা উচিত— ‘আমরা এই এই ক্ষেত্রে আলাদা।’ সেই যে একটি প্রাচীন গল্প আছে : এক রাজা রাজ্যের সবচাইতে হাতযশসম্পন্ন চতুর তাঁতির কাছে সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি করতে দিলেন, তাঁতি ভুলে গেলেন বস্ত্র তৈরি করতে এবং রাজাকে একটি অদৃশ্য বস্ত্র দিয়ে বললেন, ‘কেবল বুদ্ধিমানেরাই এই বস্ত্র দেখতে পাবে, বোকারা দেখতে পাবে না।’ রাজা সেই অদৃশ্য বস্ত্র সানন্দে পরিধান করলে এক কবির ভাষায়— ‘রাজাকে বস্ত্রহীন দেখিয়াও ‘সবাই হাততালি দিচ্ছে।/ সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাস, শাবাস! কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়:/ কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে:/ কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ/ কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক:/ কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম, চোখে পড়ছে না যদিও, তবু আছে,/ অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।/ গল্পটা সবাই জানে।…’
এই গল্পের মতো তৃতীয় বিশ্বের ‘পরিবর্তন’ও সম্ভবত বুদ্ধিমানরাই কেবল চোখে দেখছেন। কে হায় বোকা হতে চাইবে!