বিষ্ময়কর হলেও সত্য, ‘টাইম অ্যান্ড টাইড ওয়েট ফর নান’, তথা সময় ও নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না—এই দাবি মিথ্যা প্রমাণ করেছেন আধুনিক বিজ্ঞানীরা! অর্থাৎ, সময় বা নদীর স্রোত সর্বদা বহমান—এটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। আগে মনে করা হতো, সময় বয়েই চলেছে; কিন্তু আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’র পর আমরা জানতে পারি, সময় মূলত আপেক্ষিক বিষয়। সমগ্র পৃথিবীতে এটা একইভাবে প্রবাহমান নয়। স্টিফেন হকিংয়ের ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বইয়ে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়েছে। যেমন, দুই যমজ শিশুর একজনকে যদি সমুদ্রসৈকতে এবং অন্য জনকে পাহাড়ের চূড়ায় রাখা হয়, তাহলে অনেক বছর পর দেখা যাবে, তাদের বয়স দুই জনের দুই রকম হয়েছে। এর কারণ, উচ্চতাভেদে সময়ের গতিও ভিন্ন। হকিং ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন, এটা কোনো কাল্পনিক কাহিনি নয়। স্যাটেলাইট থেকে যখন সিগন্যাল পাঠানো হয়, তখন একেক উচ্চতায় সময় যেই একেক গতিতে চলছে, সেই হিসাবের কথা মাথায় রেখেই তা পাঠানো হয়।
একইভাবে, আমরা জানি যে, আলো সর্বদা সরলরেখার মতো সোজা চলে, যা সঠিক নয়। এই দাবির স্বপক্ষে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যে, আলো যখন কোনো বড় গ্রহের পাশ দিয়ে যায়, তখন সেই গ্রহের টানে আলো বেঁকে যায়। স্বয়ং আইনস্টাইন এই দাবিকে অস্বীকার করতে পারেননি; পরবর্তী সময়ে তিনি সহমত প্রকাশ করে বলেন, ‘সূর্যগ্রহণের সময় এই বাঁক দেখতে পাওয়া যায় বা যাবে’। মজার ব্যাপার হলো, তার কথাই এখন সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। সূর্যগ্রহণের দিন বৈজ্ঞানিকেরা প্রমাণ করেছেন যে, আলো বেঁকে যায়, অর্থাৎ এটা সব সময় সরলরেখায় চলে না।
এই ধরনের নানা উদাহরণ, কার্যকারণ কিংবা যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অনেক সত্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেওয়া যাবে! তবে দিনশেষে একটি বিষয়ের কোনো পরিবর্তন ঘটে না; আর সেটা হলো, ‘পরিবর্তন’। সহজ করে বললে, ‘পরিবর্তন’ সর্বদা স্থায়ী—এর কোনো রদবদল বা রকমফের নেই। সৃষ্টির শুরু থেকে অদ্যাবধি এমন কোনো জিনিস বা বিষয় পাওয়া যাবে না, যা অপরিবর্তিত রয়েছে। যারা এই দাবির সঙ্গে দ্বিমত করতে চান, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় মহাপ্রলয়ের কথা, যেদিন এই বিশ্বব্রক্ষাণ্ড একদম উলঠপালঠ হয়ে যাবে। অর্থাৎ, সকল কিছুতে ‘পরিবর্তন’ অবধারিত ও সুনিশ্চিত। কেবল পরিবর্তনই ‘স্থায়ী’। মূলত এই কারণেই পরিবর্তনকে আখ্যায়িত করা হয় ‘জীবনের একমাত্র ধ্রুবক’ হিসেবে। কেবল ব্যক্তিজীবন বা চারিপাশের জগৎ নয়, এই পৃথিবীর বাইরেও পরিবর্তনের প্রশ্নে নানা কিছুর আয়োজন চলছে সভ্য জগতের মানুষের হাত ধরে। দেশে-দেশে পরিবর্তন, দেশ ও দশে পরিবর্তন! পরিবর্তন অর্থনীতিতে, পরবির্তন রাজনীতিতে। অবকাঠামো, অফিস আদালত, আইন-কানুন, কৃষ্টি-কালচার থেকে শুরু করে মুখের ভাষা বা বুলি—কী নেই পরিবর্তনের মহাযজ্ঞ তালিকায়! বস্তুত, এই কারণেই ‘চেঞ্জ ইজ দ্য ফ্যাক্ট এভারিহোয়ার’, তথা পরিবর্তনই সজ জায়গায় আসল ঘটনা—এ ধরনের কথা আধুনিক সমাজের মানুষের মুখে মুখে পরিচিতি পেয়ে গেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যেই পরিবর্তন নিয়ে মনুষ্যকূলের এতো ভাবনা বা কল্পনা, তা কি সর্বাবস্থায় সুখকর? সব পরিবর্তনই কি প্রত্যাশিত? এই প্রশ্নের সুন্দর উত্তর দিয়েছেন প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক বক্তা ডেনিস উইটলি। তার মতে, ‘জীবনে অবশ্যই পরিবর্তনকে মেনে নিতে হবে; তবে সেই পরিবর্তনকেও হতে হবে নিয়ম হিসেবে, জীবনের নিয়ন্ত্রক হিসেবে নয়।’ অর্থাৎ, পরিবর্তনেরও একটি ধরাবাধা নিয়ম এবং উপযুক্ত সময় রয়েছে, তা কখনোই ‘বদল’ নহে! তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রতিটি পরিবর্তনকে হতে হয় ‘অর্থপূর্ণ’; অন্যথায় তা সর্বসমাজে না-ও গৃহীত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো নেতা যদি জনগণকে ধু ধু মরুভূমির বুকে কিংবা খালবিলের মাঝখানে সেতু বানিয়ে দেওয়ার কথা বলেন—যার সঙ্গে সড়কের কোনো সংযোগ নাই, সেই পরিবর্তন কি কোনো কাজে আসবে? জনগণ কি তা সানন্দে গ্রহণ করবে?
সুতরাং, পরিবর্তনকে প্রকৃত অর্থেই ‘পরিবর্তন’ হতে হবে; কোনোক্রমেই ‘নতুন বোতলে পুরাতন মদ’ হওয়া চলবে না। প্রতিটি সমাজের মানুষ উত্তোরত্তর পরিবর্তন প্রত্যাশা করে, পরিবর্তনের আশায় বুক বাধে; কিন্তু সেই পরিবর্তন যদি নিছক ‘পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তন’ হয় কিংবা প্রকৃত পরিবর্তন না হয়ে বরং ‘নিয়ন্ত্রক’ হয়ে ওঠে, তাহলে আর বিড়ম্বনার অন্ত থাকে না!