এ বছর সেরা তথ্যচিত্র হিসেবে অস্কার পুরস্কার জিতেছে ‘নো আদার ল্যান্ড’ ডকুমেন্টারি ফিল্ম। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের চার নাগরিকের তৈরি করা এই ডকু ফিল্মে উঠে এসেছে অধিকৃত পশ্চিম তীরের ‘সম্প্রদায়ের ধ্বংসের কাহিনী’। কীভাবে পশ্চিম তীরের বাসিন্দারা তাদের জমিতে ইসরাইলি ‘ফায়ারিং জোন’ ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তা-ই এ তথ্যচিত্রের বিষয়বস্তু।
সত্যি বলতে, গাজা যুদ্ধের দামামায় ‘পশ্চিম তীর ইস্যু’ আলোচনার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। ফলে এই ভূখণ্ডে আদতে কী চলছে, তা বোঝার সুযোগ কম। ঠিক এমন একটি মূহূর্তে ‘নো আদার ল্যান্ড’ তথ্যচিত্রের মাধ্যমে বিশ্ববাসী কিছুটা হলেও খবর পেল পশ্চিম তীরের! আলো পড়ল এ অঞ্চলে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের দৈনন্দিন দুর্দশার ওপরও। অথচ গাজা যুদ্ধের সংঘাতসংকুল পরিস্থিতির মুখে কাঁপতে থাকা এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের কথা যেন সবাই ভুলেই গেছে।
বিশেষ করে, বিগত দেড় বছরের বেশির ভাগ সময় সঙ্গত কারণেই ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত আলোচনায় বেশি গুরুত্ব পেয়েছে গাজা যুদ্ধ। গণমাধ্যমসহ সভা-সেমিনারগুলোতে বেশি শোনা গেছে গাজা উপত্যকার নাম। পাশাপাশি ছিল বিশ্বব্যাপী নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর ভিড়! সব মিলিয়ে পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি একপ্রকার দৃষ্টিসীমার বাইরেই পড়ে যায়, যা খুবই দুঃখজনক।
গাজার সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ থেকে একটি শিক্ষা নেওয়া উচিত। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যকার এবারকার সংঘাতের পর একটা বিষয় নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে পেরেছেন; আর তা হলো, এ সংঘাতকে উপেক্ষা বা অবহেলা করার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ হতে পারে। এই ভূখণ্ডের গণ্ডগোল ‘চোখে চোখে না রাখলে’ মূল্য চোকাতে হবেই।
ইসরাইলি ভূখণ্ডে হামাসের নজিরবিহীন হামলা এবং তার সূত্র ধরে গাজায় ইসরাইলের সর্বাত্মক সামরিক আগ্রাসনের নারকীয় চিত্র প্রত্যক্ষ করেছে তামাম বিশ্বের মানুষ। সেই গাজা উপত্যকা আজ পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে! কী বীভত্স সেখানকার পরিস্থিতি!
যুদ্ধে গাজা পুরোপুরি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সেখানে এখন নতুন অবকাঠামো বানানোর পরিকল্পনা করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি গাজাবাসীর উদ্দেশে এমন হুংকারও দিয়েছেন যে, তারা যদি এ উপত্যকা থেকে সরে যেতে রাজি না হয়, তাহলে তাদের ‘মরতে হবে’। অর্থাত্, এই সংঘাতের ভবিষ্যত্ ঠিক কোন পথে, তা স্পষ্ট বোঝার উপায় নেই এখনো।
ইসরাইল-গাজা সীমান্তে এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে—সেটাই স্বাভাবিক। একইভাবে চরম উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজমান ইসরাইল-লেবানন সীমান্তে। এই দৃশ্য দেখে খুব সহজেই আন্দাজ করা যায় অধিকৃত পশ্চিম তীরের নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিষয়ে। কেমন আছে ওয়েস্টার্ন ব্যাংক, কী হচ্ছে সেখানে?
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, দিনকে দিন কেবল খারাপই হচ্ছে পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি। বিশেষ করে, এর উত্তরাঞ্চলের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। এ এলাকায় বসবাসরত হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে এরই মধ্যে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।
এই একটি বিষয় বুঝতে পারলেই ‘পশ্চিম তীর ইস্যুর ভবিতব্য’ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যাবে। প্রকৃতপক্ষে এখানে যা ঘটছে, তা কেবল সংঘাতের বিস্তারই নয়, উপরন্তু ইসরাইলের পশ্চিম তীর দখল করে নেওয়ার আশঙ্কাকেও ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। তেলআবিবের হাবভাবে সেই গন্ধই পাওয়া যায়! অর্থাত্, পশ্চিম তীরেও গাজার মতোই আচরণ করে বসে কি না ইসরাইল, সেই শঙ্কার অবকাশ রয়েছে।
পশ্চিম তীর নিয়ে ইসরাইলের বর্তমান কৌশল অনেকটা গাজায় পরিচালিত যুদ্ধের কৌশলের মতোই। সামরিক অভিযানের ব্যাপ্তি ও তীব্রতার দিক থেকে হয়তো গাজা ও পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি এক নয়, কিন্তু সেখানকার মানুষের ওপর দিয়েও যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
পশ্চিম তীরের বিদ্রোহীদের দমন করতে ‘অতি-সহিংস মাত্রার শক্তি’ প্রয়োগ করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবন ও মানবাধিকারকে করা হচ্ছে অবজ্ঞা, অবহেলা। থেমে নেই হতাহতের ঘটনাও। তবে এর চেয়েও বড় দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে পশ্চিম তীরবাসীকে। সম্প্রতি ইসরাইল তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে যেন উঠেপড়ে লেগেছে! তাদের বলা হচ্ছে, এই অঞ্চলে হামাস সেনারা আত্মগোপন করে আছেন। চিন্তার আসল কারণ এখানেই। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ঠিক এই কথাটির অজুহাতেই গাজায় লাগাতার বোমা বর্ষণ চালিয়ে গেছে ইসরাইলি বাহিনী। অর্থাত্, পশ্চিম তীর নিয়ে ইসরাইলি সেনাদের মাথার মধ্যে কী চলছে, সেটাই বিষয়!
পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি ক্রমবর্ধমানভাবে খারাপ হচ্ছে। এর কারণ, গাজায় বসতি স্থাপনের খায়েশ এত দিন উগ্র ডানপন্থিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও আরো কিছু পক্ষ এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। উল্লেখ্য, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের বেশির ভাগই ইসরাইলি। তাদের দেখলে যেন মনে হয়, এই এলাকা একা তাদেরই, এখানে শুধু তাদের রাজত্বই চলবে। ফলে তারা আরো ভূমি দখল এবং নতুন করে বসতি স্থাপনের জন্য ছক কষছে মনে মনে!
ঘটনা আছে আরেক জায়গায়! ঐ ইসরাইলি উগ্র ডানপন্থিদের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চরমপন্থিরা স্থানীয় জনগণের সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে সংঘর্ষ বাঁধানোর পাঁয়তারা করছে। তারা এমন সব ইস্যু তৈরি করছে, যাতে করে মুখোমুখি সংঘর্ষের আশঙ্কা বেড়ে যায়। চিন্তার আরো কারণ হলো, অভিযোগ আছে—এসব চরমপন্থির ‘গোপন যোগাযোগ’ আছে কোনো কোনো ইসরাইলি পার্লামেন্ট (নেসেট) মেম্বারের সঙ্গে।
অর্থাত্, একদিকে উগ্র-ডানপন্থি ও চরমপন্থিরা পশ্চিম তীরসহ আশপাশের এলাকা দখল করে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে, অন্যদিকে ঐসব জনপ্রতিনিধি পার্লামেন্টে এমন সব নীতি ও আইন প্রণয়ন করার কাজটি করে চলেছেন, যা অধিকৃত পশ্চিম তীরের মাটিতে ইসরাইলিদের আরো সংহত করছে। সহজ করে বললে, এই অঞ্চল নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ এমন সব কূটকৌশল নিয়ে এগোচ্ছে, যাতে করে ফিলিস্তিনিদের মুক্তির সম্ভাবনা আস্তে আস্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। ঘটনা এতটুকুতেই থেমে নেই। দমন-পীড়নের প্রতিক্রিয়ায় দানা বাঁধছে নতুন বিদ্রোহের শঙ্কা।
পশ্চিম তীরে নতুন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে ইসরাইল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও এই প্রবণতা নতুন নয়। মূলত হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার বহু আগে থেকেই এমনটা চলে আসছে। বেকার, হতাশ তরুণদের নিয়ে গঠিত এসব গোষ্ঠীর বেশির ভাগই নতুন এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো সংযোগ নেই। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) নেতৃত্বের ওপরও তাদের আস্থা নেই। আর এ কারণেই উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকছে তারা।
যা হোক, হামাসের সঙ্গে এ বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি যুদ্ধবিরতি হওয়ার পরপরই ইসরাইলি বাহিনীর দৃষ্টি পড়ে পশ্চিম তীরের উত্তরাঞ্চলের দিকে। ইতিমধ্যে এই এলাকার জেনিন, তুলকারেম ও তুবাসের মতো শহরের বাসিন্দারা দেখে ফেলেছে ‘কঠোর ইসরাইলি সামরিক অভিযান’। দুঃখজনকভাবে এসব অভিযানের বেশির ভাগই পরিচালিত হচ্ছে শরণার্থী শিবিরে।
এমন একটি অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, পশ্চিম তীর কি বেদখল হয়ে যাওয়ার পথে? ইসরাইলি দখলদারিত্বের নিষ্ঠুরতা নতুন কিছু নয়, বরং যত বেশি এই দখলদারিত্ব শেকড় গেড়ে বসছে, ততই বর্বর হয়ে উঠছে বসতি স্থাপনকারী ইসরাইল নাগরিক ও সেনারা। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর এখন এ অঞ্চলে একটাই কাজ; আর তা হলো, ইসরাইলি বসতকারীদের সেবা করা। তাদের যেন সেসব ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের পক্ষে কাজ করার জন্যই নিযুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে, যারা চরমপন্থি ও ইহুদি আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী, তাদের আগলে রাখার কাজটি বহাল তবিয়তে করে যাচ্ছেন ইসরাইলি সেনারা। আর এতে করে পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদের মনোবল ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। তারা যেন এক অজানা গন্তব্যে পাড়ি দেওয়ার প্রহর গুনছে। সবার মনে একই প্রশ্ন—তাদের গন্তব্য ঠিক কোথায়?
লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ও চাথাম হাউজের গবেষক
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : সুমৃৎ খান সুজন