উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যেন এক বহুলচর্চিত কৌশল। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিরোধী পক্ষকে দমন করে রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম। সম্প্রতি ইমরান খান ও তার স্ত্রী বুশরা বিবির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে নতুন আটটি মামলা দায়েরের ঘটনা এর সর্বশেষ উদাহরণ। ইমরান খানের পিটিআই দলের ‘চূড়ান্ত বিক্ষোভ’ কর্মসূচি ঘিরে এই মামলা করা হয়েছে। ইমরান খানের দলের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস, সরকারি কাজে হস্তক্ষেপ এবং আইন ভাঙার মতো বিভিন্ন অপরাধের। তবে এই অভিযোগগুলোকে নেহাতই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অনেক বিশ্লেষক বিবেচনা করছেন। কারণ, ক্ষমতায় আসীন সরকার যখন নিজে সমালোচনার মুখে পড়ে, তখন প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করে তার শক্তি ক্ষয় করার চেষ্টা প্রায়শই দেখা যায়।
পাকিস্তানের এই ঘটনা তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের রাজনীতির এক দৃষ্টান্ত। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা প্রদান এবং তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের উন্নয়নশীল গণতন্ত্রের দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ । আফ্রিকান দেশগুলোতেও এই সমস্যা গভীরভাবে প্রোথিত। কেনিয়া, নাইজেরিয়া ও উগান্ডার মতো দেশে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো বিরোধী দলের ওপর দমনমূলক মামলা চাপিয়ে দেয়। এই মামলাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদি হয়, যাতে বিরোধী পক্ষ রাজনীতি করার সুযোগই না পায়। নাইজেরিয়ায় ২০১৫ সালের নির্বাচনের আগে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের ওপর ব্যাপক মামলা দায়েরের প্রবণতা রাজনৈতিক দমন-নীতির এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এই রাজনৈতিক প্রহসনের প্রভাব বহুমুখী। এ যেন এক অন্ধ কানাগলি! এই কানাগলি হতে তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি বের হতে পারছে না। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এর ক্ষতি সীমাহীন। প্রথমত, এটা গণতান্ত্রিক চর্চাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। বিরোধী পক্ষ দমন করে একটি ‘পক্ষীয়’ রাজনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়, যাতে সাধারণ জনগণ তাদের প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচন করার সুযোগ হতে বঞ্চিত হয়। দ্বিতীয়ত, এটা বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থাহীনতা বৃদ্ধি করে। জনগণের মনে এই ধারণা জন্মে যে, বিচারব্যবস্থা ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার মাত্র। তৃতীয়ত, এই ধরনের মামলা রাজনৈতিক মেরুকরণ আরো তীব্র করে তোলে। ফলস্বরূপ, সামাজিক ঐক্য নষ্ট হয় এবং জনমনে ক্রমাগত হতাশা বৃদ্ধি পায়।
তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে জনপ্রতিনিধিরা তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে আইনকে ব্যবহার করবে, ইহা পূর্বানুমেয়। তবে এই প্রবণতা থামাতে শক্তিশালী আইনি কাঠামো এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থার বিকল্প নেই। বিচার বিভাগ যদি রাজনীতির প্রতাবমুক্ত থাকতে পারে, তাহলে এটা অনেকাংশে আলোচ্য সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলো যদিও এই সমস্যায় জর্জরিত, তারাও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মাধ্যমে কিছু ক্ষেত্রে সুষ্ঠু সমাধান আনতে সক্ষম হয়েছে। সেখানে আদালত রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই দৃষ্টান্ত তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে।
তবে এটাও সত্য যে, এই পরিবর্তন সহজ নয়। যে সমাজে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা গভীরভাবে গ্রোথিত, সেখানে এর মূলোচ্ছেদ করতে সময় লাগবে। যথার্থ গণতান্ত্রিক চেতনা ও সুশিক্ষার মাধ্যমে একটি সচেতন প্রজন্মই এই ধারা পরিবর্তনের পথ দেখাতে পারে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এই ধারার অবসান ঘটাতে হলে সব পক্ষের মধ্যে ঐক্য এবং সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। আর তার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও রাজনৈতিক মনস্তত্বের সংস্কার প্রয়োজন। ত্যাগ করতে হবে প্রতিপক্ষকে দমনের প্রতিহিংসার মানসিকতা। কারণ, ক্ষমতা হাতে পেয়ে যে অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে আজ ঘায়েল করা হচ্ছে, ক্ষমতা চলে গেলে তা-ই আগামীকাল বুমেরাং হয়ে যাবে।
সুতরাং, এই কানাগলি হতে বের হতে না পারলে তৃতীয় বিশ্বের জনমনে কখনো শান্তি আসবে না। উন্নয়নও টেকসই হবে না। এই প্রহসনের অবসানই তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের পথে প্রধান চ্যালেঞ্জ।