বিশ্বে এখন হিংসা ও প্রতিহিংসা পাল্লা দিয়ে চলছে। ক্ষুব্ধ হওয়ার যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে বৈকি। কিন্তু তা হতে উদ্বুদ্ধ প্রতিহিংসায় ঘৃণারই চাষ হয়। সেই ঘৃণা হতে জন্ম নেয় আরো ঘৃণা। সেই ঘৃণা আরো প্রতিহিংসা এবং অশান্তি ডেকে আনে। দুঃখের সাথে বলতে হয়, এই বিশ্ব হিংসা ও প্রতিহিংসার অন্ধকারময় চক্রে ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে। ব্যক্তিপর্যায় হতে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রতিহিংসা ও ঘৃণার প্রভাব বিদ্যমান। প্রতিহিংসা সমাজকেও দ্বিধাবিভক্ত করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে নেলসন ম্যান্ডেলার শান্তিপূর্ণ সংগ্রামকে স্মরণ করা যেতে পারে। তার নেতৃত্বে ট্রুথ এ্ল রিকনসিলিয়েশন কমিশন বা ‘সত্য ও পুনর্মিলন কমিশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা প্রতিহিংসার পথে না গিয়ে শান্তি ও সমপ্রীতির ভিত্তি স্থাপনে সচেষ্ট হয়। ম্যান্ডেলা নিজেই বলেছিলেন, ‘প্রতিহিংসা পোষণ করে রাখলে তা আপনার আত্মাকে বিষাক্ত করে তুলবে।’ তার এই শিক্ষাই প্রমাণ করেছে যে প্রতিহিংসা ত্যাগ করা গেলেই কেবল সত্যিকার সমাধান সম্ভব।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমরা আরও দৃষ্টান্ত পাই, যা প্রতিহিংসার বিপরীতে সমঝোতার গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমঝোতা ও শর্তের ভিত্তিতে জাপানের ওপর নির্যাতন আরোপের পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পুনর্গঠনে সাহায্য করেছিল। এর ফলস্বরূপ, জাপান আজ উন্নয়নের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে, পরাজিত জার্মান জনগণের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে আবার বৈশ্বিক অস্থিরতার সৃষ্টি করেছিল। বস্তুত, প্রতিহিংসা এবং ঘৃণার কারণে ক্ষতি হয় কেবল সাময়িকভাবে নয়; বরং এটা ভবিষ্যত প্রজন্মকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। এটা এক অন্ধকার চক্রের সৃষ্টি করে, যা হতে মুক্তি লাভ করা কঠিন। অতএব, ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিহিংসার পরিবর্তে সংলাপ, সহমর্মিতা এবং ক্ষমার পথ অবলম্বন করা উচিত। প্রতিহিংসার বিষয়ে মনীষীরা বলে থাকেন, প্রতিহিংসা যেখানে রাজত্ব করে, সেখানে শান্তি চিরকাল শৃঙ্খলিত থাকে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারেরও মার্চেন্ট অব ভেনিসের একটি বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে: ‘The quality of mercy is not strained; it droppeth as the gentle rain from heaven.’ অর্থাৎ, দয়ার গুণ চাপিয়ে দেওয়া যায় না; এটা স্বর্গ হতে পড়া কোমল বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে। এই কথাটি ক্ষমার গুরুত্ব এবং প্রতিহিংসার খারাপ দিকটি প্রকাশ করে। অর্থাৎ, প্রতিহিংসা কখনো বৃহত্তর ও টেকসই শান্তি ও সমৃদ্ধি আনে না। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিহিংসায় ক্ষতি হয় উভয় পক্ষ। সুতরাং প্রতিহিংসা ও ঘৃণা ত্যাগ করতে হবে বৃহত্তর স্বার্থে। এটা ব্যক্তিপর্যায়ে, সমাজ পর্যায়ে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সত্য।
অতএব, ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিহিংসার পরিবর্তে সংলাপ, সহমর্মিতা এবং ক্ষমার পথ অবলম্বন করা উচিত। কোনোভাবেই প্রতিহিংসার বিষবৃক্ষের শেকড়ে জলসিঞ্চন করা যাবে না। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে শান্তি ও প্রগতির পথে হাঁটতে চাই, তাহলে প্রতিহিংসা এবং ঘৃণা ত্যাগ করে সম্প্রীতির মাধ্যমে একসাথে চলার অভ্যাস করতে হবে। কেবল তাহলেই আমরা একটি টেকসই, সমৃদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে পারব।