আজকের বিশ্বে মাদকাসক্তি একটি ভয়াবহ সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা। বিশেষ করে, তরুণ সমাজ মাদকের করাল গ্রাসের শিকার। এহেন প্রবণতা একদিকে যেমন তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে তুলছে, তেমনি সমাজে সৃষ্টি করছে অস্থিরতা।
বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, মাদকাসক্তি কেবল শারীরিকভাবেই নয়, বরং মানসিক দিক থেকেও ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস, চিন্তাভাবনা ও মনোজগতকে বিপর্যস্ত করে তোলে। বিশেষ করে, তরুণদের ক্ষেত্রে মাদকাসক্তির প্রভাব অত্যন্ত প্রকট। তাদের চিন্তা-ভাবনা এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিতে পারে সর্বনাশা মাদক।

আমাদের সমাজকে মাদক গিলে খাচ্ছে, সচেতন মহলের মুখে এমন কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। তাদের দাবি অমূলক নয়। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করে আসছি, বিশেষত এই শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই আমাদের সমাজগুলোতে মাদকদ্রব্যের বিস্তার ঘটতে শুরু করে। এরপর একটু একটু করে সমাজে এখন যেন মাদকের বিস্তার জাল! গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় পর্যন্ত এখন মাদকদ্র্য কেনাবেচা হয় দেদার! মদ. গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে আইসের মতো মাদক ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এই প্রবণতা আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এরূপ একটি অবস্থায় মাদকাসক্তি মোকাবিলা করা শুধু একটি সমস্যা সমাধান নয় বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। তরুণ প্রজন্মকে মাদক থেকে দূরে রাখতে হলে তাদের মনন এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। মাদক-মুক্ত সমাজের জন্য প্রথমে দরকার একটি সুস্থ মনন, যেটি নিজেকে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে, মানসিক স্বাস্থ্য এবং মাদক প্রতিরোধ একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তরুণরা যদি মানসিকভাবে সুস্থ থাকে, তাদের চিন্তা-ভাবনা পরিষ্কার এবং পরিপক্ক হয়, তাহলে তারা কখনো মাদকাসক্তির দিকে পা বাড়াবে না।
মাদকমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সমাজের সমষ্টিগত সচেতনতা। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের মানুষের কাছে মাদকবিরোধী সচেতনতা পৌঁছানো জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মাদক প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা কর্মসূচি চালু করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা মাদকাসক্তির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হয় এবং তা থেকে বিরত থাকে।
মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের বিকল্প নেই। কেবল লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধান ঘটবে না। দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর জোগশাজসে এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এসব নেশাদ্রব্য ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে! কেবল মুনাফার লোভে পড়েই এহেন অপকর্ম করে যাচ্ছে তারা! অথচ এই নেশার ছোবলে বহু পরিবার পথে বসে যাচ্ছে। সুতরাং, এই প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। পুলিশের কিংবা সরকারের যেসব সদস্য মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তাদের সনাক্ত করতে হবে; নিতে হতে শাস্তিমূলক কঠোর ব্যবস্থা।
সঠিক পুনর্বাসন কেন্দ্র, মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও মাদক প্রতিরোধ কর্মসূচি তরুণদের মধ্যে সাড়া ফেলতে পারে। তবে, এইসব উদ্যোগ সফল হবে তখনই, যখন একটি বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন তৈরি হবে এবং সেখানে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকবে। তাই, তরুণদের মাদক থেকে দূরে রাখতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান এবং সেই সাথে সমাজের মধ্যে এক দৃঢ় সচেতনতা তৈরির জন্য সকলেকে একযোগে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সমাজ থেকে নেশা-প্রবণতা দূর করা গেলে প্রাণ ফিরে পাবে আমাদের তরুণ সমাজ; প্রাণ ফিরে পাবে এই সুন্দর সমাজ-পৃথিবী।
লেখক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা এবং সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ফিচার কলাম আ্যান্ড কনটেন্ট রাইটার্স।
ইমেইল : malihamehnaj394@gmail.com