গত ৫ মার্চ বুধবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাত্রঁ জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন, যেখানে তিনি ফ্রান্সের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। এই পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ, যা ইউক্রেনকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে ইউরোপের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন কমিয়ে দেওয়ায় ফ্রান্স এখন একটি মধ্যস্থতাকারী শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, যা ইউক্রেন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান আনতে পারে।
ম্যাক্রঁর ভাষণে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। তিনি ইউরোপের জন্য ‘রাশিয়ার হুমকি’ সম্পর্কে সতর্কতা জারি করেছেন এবং ফ্রান্সের পারমাণবিক নীতিতে পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন, যা ইউরোপীয় মিত্রদের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। এই নতুন নীতিগুলো এমন এক সময়ে ঘোষণা করা হয়েছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যে ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে, যা ইউরোপের অর্থনীতিকে আরো সংকটে ফেলেছে। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ইউক্রেনের প্রতি অবিচল সমর্থন থেকে সরে এসেছে। ফলে সামরিক গোয়েন্দা সহযোগিতা ও অস্ত্র চালানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে ইউরোপের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ম্যাক্রঁর ভাষণের অন্যতম বিতর্কিত অংশ ছিল ফ্রান্সের সামরিক বাজেট ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা, তবে কোনো নতুন কর আরোপ না করে। এটি কীভাবে সম্ভব হবে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদ এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় ছিল, ফ্রান্সের পারমাণবিক অস্ত্র নীতির পরিবর্তনের প্রস্তাব। তিনি উল্লেখ করেছেন, ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফ্রান্সের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কৌশল পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে।
এই ঘোষণার পর ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তার নীতির উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে মনে করছেন, তিনি ইউরোপের নিরাপত্তাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন এবং পারমাণবিক অস্ত্রের মতো সংবেদনশীল বিষয়কে কৌশলগত খেলায় পরিণত করছেন। গত কয়েক বছরে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আফ্রিকার দেশগুলো, যেমন নাইজার, বুরকিনা ফাসো, মালি এবং চাদ, একে একে ফ্রান্সের সামরিক ঘাঁটিগুলো সরিয়ে দিয়েছে, যার ফলে আফ্রিকায় ফ্রান্সের প্রভাব কমে গেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তনও ইউরোপের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র এখন ইউরোপের প্রতিরক্ষা দায়িত্ব কমিয়ে আনছে এবং ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া থেকে ক্রমশ পিছিয়ে আসছে। ম্যাক্রঁ এই শূন্যস্থান পূরণ করতে চাইছেন এবং ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নির্ভরতা থেকে বের করে এনে একটি স্বাধীন প্রতিরক্ষা শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন।
তবে এখানে একটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। তিনি একদিকে ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, অন্যদিকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা উন্মোচন করছেন। এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ইউরোপের মিত্রদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হলে তা শুধু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং বিষয়টি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে আরো উসকে দিতে পারে।
গত ৬ মার্চ, বৃহস্পতিবার, ব্রাসেলসে একটি জরুরি বৈঠকে ইউরোপীয় নেতারা ফরাসি প্রতিরক্ষা নীতির ভবিষ্যত্ এবং ইউক্রেন সংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান দেশগুলো ঘোষণা করেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার ওপর নির্ভরতা কমাতে চায় এবং একটি অভ্যন্তরীণ ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা প্রকল্প গড়ে তুলতে চায়। এই প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্য বাজেট ধরা হয়েছে ৮০০ বিলিয়ন ডলার, যা ইউরোপের সামরিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। এই নতুন প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ফ্রান্সের পারমাণবিক অস্ত্রনীতির পরিবর্তন। এটি প্রথম চালু হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, তবে এবার এর কৌশলগত প্রয়োগ পুরো ইউরোপ জুড়ে বিস্তৃত করা হতে পারে।
জার্মানির পরবর্তী চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মের্জ ইউরোপের পুনরায় সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে ইউরোপকে আরো বেশি প্রতিরক্ষা ব্যয়ে বিনিয়োগ করতে হবে এবং নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, জার্মানির সামরিক পুনরুত্থান অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয়। দুইটি বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে জার্মানির আগ্রাসী সামরিক নীতিকে দায়ী করা হয়েছিল। এখন যদি তারা আবারও বড় আকারে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করে, তাহলে এটি ইউরোপের মধ্যে একটি নতুন উত্তেজনার জন্ম দিতে পারে।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁর বক্তব্যকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মস্কো স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, ফ্রান্স যদি পারমাণবিক অস্ত্রের কৌশল পরিবর্তন করে এবং ইউরোপের প্রতিরক্ষা প্রকল্পকে আরো আক্রমণাত্মক করে তোলে, তাহলে রাশিয়াও তার মোক্ষম জবাব দেবে। এখন প্রশ্ন হলো, ইউরোপ কি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বাধীন সামরিক শক্তি হয়ে উঠতে পারবে, নাকি তারা নতুন এক বিপজ্জনক সংঘাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর কেবল সময়ই বলতে পারে।
লেখক : ফ্রান্স-ভিত্তিক আইনজীবী
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল মামুন