বায়ুদূষণ আজ পৃথিবীর অন্যতম গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবৎসর প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ অকালমৃত্যুর শিকার হন। বাংলাদেশেও এই পরিস্থিতি ভয়াবহ। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণ এখন প্রায় প্রতিদিনই বিশ্ব তালিকায় শীর্ষপর্যায়ে অবস্থান করে। এই দূষণের প্রধান কারণ বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা—যাহা পিএম ২.৫ নামে পরিচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)—এর মানমাত্রার তুলনায় গতকাল ঢাকার বাতাসে পিএম ২.৫—এর উপস্থিতি ৩৮ শতাংশ বেশি ছিল। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য প্রধান শহরে বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগ বৃদ্ধি পাইতেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুদূষণ মানুষের আয়ুষ্কাল ২—৫ বছর পর্যন্ত হ্রাস করিতে পারে। এই অস্বাস্থ্যকর বায়ুর কারণে রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের রোগ, হৃদরোগ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়িতে হইতেছে।
ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলি হইল ইটভাটা, নির্মাণকাজের ধুলো, যানবাহনের ধোঁয়া এবং কলকারখানার বর্জ্য। উন্নত দেশগুলির অভিজ্ঞতা বিবেচনা করিলে দেখা যায়, ইহারা টেকসই পরিকল্পনা ও কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ করিয়া এই সমস্যা মোকাবিলা করিতে সক্ষম হইয়াছে। উদাহরণস্বরূপ, চীন বায়ুদূষণ রোধে ইটভাটার পরিবর্তে ক্লিনার টেকনোলজি ব্যবহার করিতে বাধ্য করিয়াছে এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াইয়াছে। বেইজিং, যাহা একসময় বিশ্বের অন্যতম দূষিত নগর ছিল, এখন তুলনামূলকভাবে নির্মল বায়ুতে শ্বাস লইতেছে। ভারতের দিলি, যাহা দূষণের জন্য বিশ্বব্যাপী কুখ্যাত—তাহারা বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ‘গ্রাডেড রেসপন্স অ্যাকশন প্ল্যান’—এর তৃতীয় ধাপ বাস্তবায়নের পথে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে দূষণের মাত্রা অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা—যেমন যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণকাজে নিয়ন্ত্রণ এবং শিল্প কারখানায় কড়া নিয়ম প্রয়োগ। ঢাকায়ও এমন একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত, যাহা দূষণের মাত্রা অনুযায়ী শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন আলাদা নীতিমালা গ্রহণ করিতে পারে। সুইডেন ও নরওয়ে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে উলেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করিয়াছে। এই দেশগুলি পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উপর নির্ভরশীলতা বাড়াইয়াছে এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যবহার উৎসাহিত করিয়াছে। ঢাকা শহরের নির্মাণকাজের ধুলো ও বর্জ্য বায়ুদূষণের বড় কারণ। উন্নত দেশগুলি যেমন সিঙ্গাপুর, তাহারা নির্মাণকাজের নিয়ম মেনে চলা বাধ্যতামূলক করিয়াছে। নির্মাণসামগ্রী আচ্ছাদন, জল ছিটানো এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কঠোর নিয়ম পালন করা হয়। ঢাকার নির্মাণসাইটগুলিতে এই নিয়মগুলি কার্যকর করা হইলে ধূলিদূষণ অনেকাংশে কমিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, নগর পরিকল্পনায় বায়ু মানের উন্নতির জন্য সবুজায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নগরীর বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষরোপণ করিলে বায়ুতে পিএম ২.৫ কণার পরিমাণ হ্রাস করা যায়। টোকিও শহর এইভাবে সবুজায়নের মাধ্যমে বায়ুমান উন্নত করিয়াছে। ঢাকায়ও সরকারি ও বেসরকারি উভয় উদ্যোগে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করিতে হইবে। বিশেষ করে, যেই স্থানগুলি দূষণে শীর্ষে থাকে, সেইগুলি চিহ্নিত করিয়া সেখানে সবুজায়ন প্রকল্প গ্রহণ করা যাইতে পারে। বায়ুদূষণ হইতে রক্ষা পাইতে জনসাধারণকে মাস্ক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা, খোলা স্থানে ব্যায়াম এড়াইয়া চলা এবং ঘরের জানালা বন্ধ রাখিবার পরামর্শ দিতেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নহে, বায়ুদূষণ দেশের অর্থনীতির উপরও বিপুল প্রভাব ফেলিতেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণজনিত রোগ ও কর্মক্ষমতা হ্রাসের কারণে বাংলাদেশ প্রতিবৎসর প্রায় ৫.৭ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হইতেছে। এই ক্ষতি দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৩.৯ শতাংশ। সুতরাং, বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করিলে, তাহা কেবলমাত্র জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি নহে, বরং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলিবে। অতএব, ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে এখনই সুদূরপ্রসারি ও টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকার ও সংশিষ্ট সংস্থাগুলিকে উন্নত দেশগুলির সাফল্য অনুসরণ করিয়া একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে হইবে। তাহা না হইলে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরো অধিক বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য হইবে।