আমাদের একটি বিজয় দিবস আছে। এই মহান দিবসটি পৃথিবীর সকল জাতির ‘নিজের করে পাওয়ার’ সৌভাগ্য হয়নি। পৃথিবীতে যুক্তরাষ্ট্রের পরে কেবল বাংলাদেশই ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল এবং বিজয় অর্জন করেছিল। তবে এর জন্য বাংলাদেশকে বিশাল মূল্য চোকাতে হয়। এক সাগর রক্ত-ক্ষয়ের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করি। বিজয়ের ৫৪ বছরে বহুক্ষেত্রেই আমরা আত্মশ্লাঘায় ভুগেছি! হয়তোবা ভুগছি এখনো। পাকিস্তানিদের পোড়ামাটি নীতির কারণে একাত্তরে তারা এই দেশটিকে নিমর্মভাবে ধ্বংস করেছে। বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলে ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা-পড়া সদ্য স্বাধীন দেশটিকে নিয়ে বিশ্বের অনেকে বড় বড় অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞই ঠাট্টা করতেন। এমনো বলা হতো যে, বাংলাদেশ যদি তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে, পৃথিবীর যে কোনো দেশই উন্নতি করতে পারবে। বলা বাহুল্য, বিজয়ের ৫০ বছর পার হতেই এই উত্তর স্পষ্ট হয় যে, বাংলাদেশ তা পেরেছে। শত সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশে বিগত অর্ধশতকে অর্থনৈতিক সামষ্টিক প্রবৃদ্ধি ৭৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৫ গুণ, বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে এবং মানুষ সুপেয় পানির সুবিধা পাচ্ছে। শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে নিশ্চয়ই, যদিও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
বিজয়ের ৫০ বছর পর আমরা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে পেরেছি, অসীম আকাশের মতোই সম্ভাবনার উজ্জ্বল দিগন্তে আমরাও ফানুস উড়াতে পারি। ব্যর্থতার পরিসংখ্যান সকলেই জানেন, তবে অর্জন যা হয়েছে, তা সার্বিক ব্যর্থতাকে ছাপিয়েই বিশ্বের নিকট সমীহ অর্জন করেছি আমরা। সেই অভাবনীয় অর্জন দিনদিন মূর্ত হয়ে উঠছে সমাজ ও অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে। আর এইভাবেই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার প্রত্যয়দীপ্ত পদশব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম এটা যেন কখনো ভুলে না যায়— স্বাধীনতার পরবতীর্কালে আমাদের যে অর্জন সম্ভব হয়েছে— তার নেপথ্যে রয়েছে আমাদের সূর্যসন্তানদের আসমুদ্র রুধিরধারার আত্মত্যাগ। আমরা যদি বাংলাদেশকে একটি কল্যাণকর ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তবেই না এই নিযুত নিযুত মানুষের আত্মত্যাগের প্রতি সত্যিকারের সম্মানজ্ঞাপন করা হবে। আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য সেটাই হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আমরা আরো স্পষ্ট করে বলতে চাই, বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটে বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি ও অদক্ষতা এখনো সহনশীল পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। অনেকের মতে, দুনীর্তি ও অদক্ষতার জন্য আমাদের বাজেটের হয় অপচয় ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। এটা সহনশীল ন্যায্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এই অপচয়ের লাগাম যদি টেনে ধরা যেত, তাহলে আমরা আরো ২৫ শতাংশ উন্নয়ন কাজ বেশি করতে পারতাম!
মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন বাজেটের অর্থ জনগণের অর্থ। তাই এর অপচয় রোধ করাটা দেশপ্রেমেরও অংশ। আমাদের মধ্যে এই দেশপ্রেমের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো, আমরা দেখতে পাই, দেশের উন্নয়নযাত্রায় বহু ক্ষেত্রেই দেশের বিভিন্ন খাতে মনোপলি ব্যাপার রয়ে গেছে। অনেকে মনে করেন, আমাদের অর্থনীতির ভেতরে নীরবে রক্তক্ষরণ ঘটছে রাঘববোয়াল দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি এবং লুটেরাদের কারণে। ব্যাংকগুলোর অবস্থা কতোটা খারাপ, তা অনেকের মনেই আশঙ্কা তৈরি করে। তারল্য সংকট ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় লক্ষ কোটি টাকা। সুতরাং, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে— এটা নিয়ে যেমন কারো মধ্যে সংশয়ের অবকাশ নেই, তেমনি এই অপচয় ও দুনীর্তিও প্রশমিত করার মাধ্যমে দেশপ্রেমের পরিচয় দেওয়ার মধ্যেও কোনো সংশয় নেই। জনগণের অর্থের যে কোনো ধরনের অপচয় রোধ করাই হোক আমাদের আজকের বিজয় দিবসের শপথ।
বাংলাদেশ এখন আর কারো অবহেলার পাত্র নয়। বিজয়ের এই ক্ষণে আমরা কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্মরণ করছি একাত্তরে আমাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ এবং সর্বতোভাবে সহযোগিতা করা ভারতসহ সকল বন্ধুরাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গকে। সকলের অপার অবদানের সমন্বয়েই আমরা বিজয় অর্জন করতে পেরেছিলাম।