পৃথিবীকে বিদায় জানালেন ৭১-এর কলম যোদ্ধা কবি হেলাল হাফিজ। রঙের দুনিয়ায় ৭৬ বছর ২ মাস ৬ দিনের সফর শেষে পাড়ি জমালেন পরকালে। ছোট এ সফরে বাংলা সাহিত্যে তিনি রেখে গেছেন অসামান্য অবদান।
‘‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’’। এই লাইন দুটি কবি হেলাল হাফিজের ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ থেকে নেওয়া। এই দুই চরণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শত শত যুবকের অংগ্রহনের উৎসাহ হিসেবে কাজ করে। এখনো বাংলাদেশের কবিতা প্রেমিদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে থাকে এই অমীয় বাণী।
১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গের জেলা নেত্রকোনায় জন্মেছিলেন এই কলম যোদ্ধা। নেত্রকোণা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি শেষ করেন ১৯৬৫ সালে এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেন। ঐ বছরই হেলাল হাফিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন।
কর্মজীবনে সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। তখনও তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবল হলের (বর্তমানে জহুরুল হক) ছাত্র। ১৯৭৫ সাল শেষ করেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। পরে ১৯৭৬ সালে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন।
১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের বিপক্ষে এক প্রকার কলম যুদ্ধের নেতৃত্বটা দিয়েছিলেন কবি হেলাল হাফিজ। সে সময় লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অসংখ্য কবিতা যার মধ্যে অন্যতম ছিলো ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’, ‘অস্ত্র সমর্পণ’, ‘একটি পাতাকা পেলে’। এছাড়া তিনি সামাজিক, প্রেম-ভালোবাসা, দেশ, রাজনীতি বিষয় নিয়েও লিখেছেন একাধিক কবিতা।
তার রচিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। তার এই প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। ২৬ বছর পর ২০১২ সালের ২১শে বই মেলায় ‘কবিতা ৭১’ নামে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যা বাংলা ও ইংরেজি দুই দুই ভাষায় প্রকাশিত হয়। তার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। তার এই অসামান্য লেখার জন্যই তিনি বাংলাদেশের একজন আধুনিক কবি হিসেবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
কবিতার জন্য তিনি পেয়েছেন নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদ্যাপন কমিটির কবি সংবর্ধনা (১৯৮৫), যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজ, কবি খালেদদাদ চৌধুরী সাহিত্য পদক সম্মাননা, বাসাসপ কাব্যরত্ন – ২০১৯ প্রভৃতি। এছাড়া কবিতার জন্য তিনি ২০১৩ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
হেলাল হাফিজ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন। তরুণ প্রজন্মের রক্তে বুদবুদ খেলার মতোই ছিলো তার লেখনির ধারা। কর্মজীবনে ছিলেন সৎ ও নির্ভিক। লিখেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ন্যায়কে দিয়েছেন বাহবা। হয়ে উঠেছিলেন বতর্মান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীর স্বপ্নদ্রষ্টা, যার দেখানো পথে হেঁটেছেন বহু তরুণ। তার কবিতার লাইন পড়ে উদ্ভূদ্ধ হয়েছেন বহু পথভ্রষ্ট যুবক। তার কবিতার শক্তিতে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তরুণরা গড়ে তুলেছেন শক্ত প্রতিরোধ।
আজ (১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪) তিনি লাখো বাঙালির হৃদয় মুচড়ে পরলোক গমন করলেন। যাওয়ার আগে বাংলা সাহিত্যে কবি রেখে গেলেন অসামান্য অবদান, যা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য এক গৌরব গাথা ইতিহাস হয়ে থাকবে। মহান এই কবির প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, রুপসা কলেজ, খুলনা।