দিন কয়েক আগেও কিয়েভকে খুব স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল! ঠিক তিন বছর আগের মতো। সত্যিই, কখনোই যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর বলে মনে হচ্ছিল না! দোকানপাট খোলা ছিল, সবাই নিজ নিজ কর্মস্থলে ব্যস্ত সময় পার করছিল। রাস্তাঘাটগুলোতেও স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তবে পরিস্থিতি পালটে যেতে থাকে বিশেষত ১২ ফেব্রুয়ারির পর থেকে। এ দিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন টানা ৯০ মিনিট ফোনে কথা বলেন।
হোয়াইট হাউজ ও ক্রেমলিনের এই ‘রাজনৈতিক আলিঙ্গন’ স্বভাবতই নতুন করে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে ইউক্রেনীয়দের মনে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু এই সংঘাত বন্ধের খবরে যখন তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ট্রাম্প-পুতিন ফোনালাপের পর পুরোনো দুঃস্বপ্ন ঘিরে ধরেছে কিয়েভবাসীকে।
তাদের বক্তব্য, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে প্রত্যাশা অনুযায়ী অস্ত্রশস্ত্র দেননি বটে, কিন্তু ইউক্রেনীয়রা ঠিকই বুঝত, তিনি আসলে কোন পক্ষে আছেন। অস্ত্র বা তহবিল আটকে যাওয়ার কারণে বাইডেন প্রশাসনের ওপর ইউক্রেনের মানুষ বেশ ক্ষুব্ধ ছিল, কিন্তু তাদের বিশ্বাস ছিল, বাইডেন তাদের পাশেই থাকবেন।

অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে অতিরঞ্জন, অসত্য-অর্ধসত্য, এমনকি ডাহা মিথ্যাচার করেছেন বলে কিয়েভের অভিযোগ। তারা এমনো দাবি করছেন, ট্রাম্প যেন পুতিনের মতামতেরই প্রতিধ্বনি করা শুরু করেছেন। তাদের গুরুতর অভিযোগ মূলত দুইটি বিষয়ে; এক. ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তিনি ‘স্বৈরশাসক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে হুংকার দিয়েছেন যে, তাকে বরখাস্ত করা উচিত। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনীয়দের ভাষ্য, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করেছে’—ট্রাম্প এই মনগড়া কথাটির মাধ্যমে কিয়েভের ওপর যে দোষ চাপাতে চেয়েছেন, তা-ও ‘সর্বাংশে মিথ্যা’।
অনেকে বলে থাকেন, ট্রাম্পের আলোচনা-কৌশলের একটি বাজে দিক হলো, কোনো গুরুতর বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা শুরু হওয়ার আগেই কোনো একটি পক্ষকে ছাড় দিয়ে দেন তিনি! তার কথাবার্তার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি আদতে কাকে সমর্থন করছেন।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গই ধরি। লক্ষণীয়, যে দেশটি তার প্রতিবেশী সার্বভৌম দেশকে আক্রমণ করে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে, যে দেশটি বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ এবং লাখ লাখ মানুষের নিহত ও আহত হওয়ার কারণ, তার ওপর চাপ প্রয়োগের পরিবর্তে বরং উলটো ইউক্রেন নিয়ে পড়ে আছেন ট্রাম্প! ট্রাম্পের প্রকাশ্য বক্তব্য বা কথাবার্তায় একদম স্পষ্ট যে, ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তুর্ভুক্ত করা হবে না। শুধু তা-ই নয়, রাশিয়া বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল দখল করে নিয়েছে, তাও ফেরত দেওয়া হবে না কিয়েভকে। বরং মনে হচ্ছে, অন্তত কিছু অঞ্চল নিজের কাছেই রাখবে মস্কো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভ্লাদিমির পুতিনের অতীত রেকর্ড দেখে বেশ ভালোমতো বোঝা যায় যে, তিনি শক্তিধর পক্ষকে সম্মানের চোখেই দেখেন। ‘ছাড়’ পাওয়াকে শত্রুর দুর্বলতার লক্ষণ বলে মনে করেন; অর্থাত্, যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে ট্রাম্পের ছাড় দেওয়ার মনোভাব জানার পর স্বভাবসুলভ ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করবেন পুতিন!
বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ হলো, এই যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের মালিকানার দাবি থেকে এক পা-ও পিছপা হননি পুতিন। এমনকি ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরুর পর সম্প্রতি সৌদি আরবে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রথম বারের মতো যে আলোচনা হয়েছে, সেখানেও মস্কোর একই রকম মনোভাব লক্ষ করা গেছে। পুতিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ মস্কোর দাবি পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদানের অজুহাতে কোনো ন্যাটো সেনাকে ইউক্রেনে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।’
ল্যাভরভের এহেন গোয়ার্তুমি মনোভাব লক্ষ করে রাশিয়া ও মার্কিনদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করা এক অভিজ্ঞ ইউরোপীয় কূটনীতিক মন্তব্য করেছেন এভাবে যে, ‘অত্যন্ত অভিজ্ঞ লাভরভ যখন ট্রাম্পের নবীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন, তখন তার ধূসর চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি তাকে (রুবিও) নরম-সেদ্ধ ডিমের মতো খেয়ে ফেলবেন।’
সামনে আরো চ্যালেঞ্জিং সময়
কয়েক দিন আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ট্রাম্প যখন অপমানজনক মন্তব্য করেন, সে সময় কিয়েভে সরকারি কোয়ার্টারে কড়া পাহারায় থাকা ভলোদিমির জেলেনস্কির সিনিয়র উপদেষ্টা এবং প্রেসিডেন্ট অফিসের উপপ্রধান ইহোর ব্রুসিলোর সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ হয়। ব্রুসিলো স্বীকার করেন, ট্রাম্প তাদের ওপর ব্যাপক চাপ দিচ্ছেন! তার ভাষায়, ‘এটা খুবই কঠিন। এগুলো সত্যিই খুবই কঠিন, চ্যালেঞ্জিং সময়।’ তিনি যোগ করেন, ‘আমি বলব না যে, পরিস্থিতি ২০২২ সালের চেয়ে ভালো। তবে যুদ্ধ বন্ধের খবরে সবকিছু আবারও সহজ-স্বাভাবিক হয়ে আসছিল।’ ব্রুসিলো বলে চলেন, ‘ইউক্রেনীয়দের সঙ্গে নিয়ে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ২০২২ সালের আগের সময়ের মতোই স্বাধীন থাকার জন্য’ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা একটি সার্বভৌম দেশ, আমরা ইউরোপের অংশ এবং আমরা এমনটাই থাকব।’
বিবর্ণ ইউক্রেন
পুতিন ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণের নির্দেশ দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরই কিয়েভের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধের যে দামামা বেজে ওঠে, তাতে ইউক্রেন দিন দিন বিবর্ণ হয়ে পড়ে। প্রায় জনশূন্য রাস্তাঘাটগুলো প্রকম্পিত হতে থাকে বুলেট-বোমার শব্দে। চেকপয়েন্ট ও ব্যারিকেড, বালির বস্তার দেওয়াল এবং স্টিলের গার্ডার থেকে শুরু করে ট্যাঙ্ক-বহর প্রভৃতি দখল করে নেয় কিয়েভের প্রশস্ত সড়কগুলো। এমন একটি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায় রেলওয়ে স্টেশনগুলো দিয়ে যাতায়াতকারী দৈনিক ৫০ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ—যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। অবশ্য জো বাইডেনের ভাষায়, কিয়েভে যে রুশ সেনাদের আক্রমণ অত্যাসন্ন—প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি আমেরিকার এই সতর্কবাণী ‘শুনতে চাননি’!
যুদ্ধের মধ্যে বেড়ে ওঠা
আগ্রাসনের পর প্রথম দিকে কিয়েভের একটি স্বেচ্ছাসেবক কেন্দ্রে দুই তরুণ ছাত্রের সঙ্গে সাক্ষাত্ হয় আমার। ১৯ বছর বয়সি ম্যাক্সিম লুটসিক এবং ১৮ বছরের দিমিত্রো কিসিলেনকো। তাদের অভিজ্ঞতা হলো, তাদের যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল, সেখানে তারা বয়স্ক পুরুষের পাশাপাশি এমন অনেক তরুণকে দেখেছিলেন, যাদের অনেককে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে টেনে আনা হয়েছে। ইউক্রেনের এই সিদ্ধান্তটি খুবই মারাত্মক। অভিযোগ আছে, যুদ্ধে যাদের জোরপূর্বক আনা হয়, তাদের অনেকেই ঘুষের বিনিময়ে পালিয়ে যান যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। এই কারণে অনেকে কথা-প্রসঙ্গে বলে থাকেন, তাদের কাছ থেকে অর্থ না নিয়ে বরং শত্রুপক্ষের সঙ্গে অর্থ-লেনদেনের মাধ্যমে যুদ্ধ মিটমাট করে নেওয়াই ভালো! এর আগে এক লেখায় আমিও বলেছিলাম, ‘জোর করে ১৮ বা ১৯ বছর বয়সি ছেলেদের যুদ্ধের মাঠে নামানো হবে, এমন দিনও দেখতে হলো ইউরোপকে!’
ট্রাম্পের প্রভাব
অনেকে দাবি করেন, আপনি যদি একজন রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার হন—যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প; (রিয়েলিটি টিভিতে আসার আগে এবং এরপর রাজনীতিতে আসার আগে তিনি এই পেশায় ছিলেন), তাহলে ধ্বংসের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের পথ তৈরি করতে চেষ্টা চলতে পারে আপনার মাধ্যমে—এই চিন্তা অবান্তর নয়! সম্পত্তি অর্জন করুন, তা ভেঙে ফেলুন, পুনর্নির্মাণ করুন এবং এভাবেই জয়লাভ করুন—পররাষ্ট্রনীতিতে এই কৌশলের ব্যবহার করতে চাইবেন! কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হলো, এতে করে অন্যের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ট্রাম্প বলেন যে, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’, তথা তিনি আমেরিকাকে সবার ওপরে এবং প্রথমে রাখতে চান, কিন্তু তিনি সম্ভবত এটা মেনে নিতে প্রস্তুত নন যে, অ-আমেরিকানরাও তাদের নিজস্ব দেশ সম্পর্কে একই রকম অনুভব করতে পারেন, অর্থাত্, তিনি যেমন তার দেশকে সবার চেয়ে আলাদা দেখতে চান, তেমনি সবাই তার নিজ নিজ দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, দ্বিতীয় বারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকেই তিনি তার ধ্বংসাত্মক বলটি ঘুরিয়েই যাচ্ছেন! এতে করে ইউরোপ তো বটেই, সমগ্র পৃথিবী আরো বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।
ট্রাম্প সম্ভবত প্রতিশোধ চান! তিনি ইউক্রেনের কাছ থেকে অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলার সমমূল্যের খনিজ সম্পদের মালিকানা দাবি করেছিলেন। জেলেনস্কি সেই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন যে, তিনি তার দেশ বিক্রি করতে পারবেন না। তিনি অন্য কোনো ছাড়ের বিনিময়ে সুরক্ষার গ্যারান্টি চান। এই কথা ট্রাম্প প্রশাসন ভালোভাবে নেবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
ইউরোপীয় রাজনীতিবিদ এবং কূটনীতিকরা স্বীকার করেন যে, জো বাইডেন ইউক্রেনকে বিজয়ী করার কথা বললেও রাশিয়াকে পরাস্ত করা যাবে, এমন মাত্রার শক্তিশালী অস্ত্র কিংবা সামরিক সরঞ্জামাদি এবং আর্থিক সহায়তা দেননি। বরং যা দিয়েছেন, তা কখনো জেতার জন্য যথেষ্ট ছিল না।
যুদ্ধ সাধারণত চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়। যেমন, ১৯৪৫ সালে জার্মানির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছিল একটি বিরল ঘটনা। ঠিক এমন একটি কার্যকর যুদ্ধবিরতি চুুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে ইউক্রেনীয়রা। তবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি কেবল অবান্তর কথাই বলে যাচ্ছেন; সংঘাত বন্ধে তার হাতে কোনো বাস্তব পরিকল্পনা নেই! আর তাই তিনি পুতিনের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য অন্তর্নিহিত প্রবৃত্তি অনুসরণ করেছেন! ট্রাম্প সম্ভবত মনে করেন যে, সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের শক্তিশালী নেতারা বিশ্বের আকার-আকৃতি তাদের পছন্দ অনুযায়ী পরিবর্তন করে নিতে পারেন। ট্রাম্প ইতিমধ্যে পুতিনকে যে ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা এই ধারণাটিকে আরো প্রবল করে তুলবে।
ট্রাম্প ও পুতিনের মুখোমুখি হওয়া
পুতিনের ভূকৌশলগত ডিএনএ-তে গভীরভাবে গেঁথে থাকা ধারণাগুলোর একটি হলো, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ভেঙে দিয়ে দেশটির নিয়ন্ত্রণ ক্রেমলিনের হাতে রাখা। অর্থাত্, সোভিয়েত আমলে এবং তার আগে রাশিয়ার জার সাম্রাজ্যে ইউক্রেনের যে অবস্থা ছিল, সেই যুগ ফিরিয়ে আনা। যদিও কীভাবে তা ঘটবে, তা বোঝা কঠিন। তবে একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার, বিগত তিন বছর ধরে চলা এই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের সার্বিক নিরাপত্তার চিত্রই পালটে যাচ্ছে।
লেখক : বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক
বিবিসি থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন