আমাদের জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলা রক্ষা করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। কেননা, আমাদের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য রক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই। মানুষ হিসেবে আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আবার ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগ করার ক্ষেত্রেও রয়েছে সীমা-পরিসীমা। তাই কোনো ক্ষেত্রেই এমন আচরণ করা উচিত নয়, যা অন্যের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে যেমন সচেতন থাকতে হবে, তেমনি অন্যের অধিকারের প্রতিও আমাদের সম্মানবোধ থাকা দরকার। প্রতিটি ধর্মের মূল ভিত্তিই হলো ইমান বা বিশ্বাস। এই বিশ্বাসবোধ মানব জীবনে শৃঙ্খলা আনয়ন করে এবং সকল প্রকার উচ্ছৃঙ্খলতা পরিহার করে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে সর্বাগ্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। কেননা, এটাই স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও অগ্রগতির ভিত্তিমূল।
প্রবাদে আছে, ডিসিপ্লিন ইজ ফার্স্ট বা শৃঙ্খলাই প্রথম। তবে আমরা মনে করি, আসলে এটা হওয়া উচিত—ডিসিপ্লিন ইজ ফার্স্ট, ডিসিপ্লিন ইজ সেকেন্ড অ্যান্ড ডিসিপ্লিন ইজ লাস্ট। অর্থাৎ, শৃঙ্খলাই প্রথম, দ্বিতীয় ও শেষ কথা। জনগণকে এজন্য নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদেরও বিধি-বিধান মেনে চলতে হবে। প্রয়োজনে সেসব নিয়ম-কানুন বা আইন সংশোধনের দাবি আমরা তুলিতেই পারি। এটা অন্যায় ও অন্যায্য নয়। কিন্তু যতক্ষণ না তা সংশোধিত হয়, ততক্ষণ আমাদের সেই নিয়ম ও আইনের মধ্যে থেকেই কাজ করে যেতে হবে। মহান গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা শিষ্যদের পরামর্শ মতো কারাগার হতে গোপনে পলায়ন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের বিচারালয়ের রায় মাথা পেতে নেন এবং আইনকে সমুন্নত রাখতে তখনকার এথেনসের বিধান অনুযায়ী এক কাপ বিষ হেমলক পান করে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন। তার এই অকম্পিতচিত্তে মৃত্যুবরণ ও আত্মত্যাগের কাহিনী শৃঙ্খলা রক্ষা ও আইনের শাসনের জন্যও শিক্ষণীয়।
বাংলাদেশে শৃঙ্খলা বিধানসংক্রান্ত যেসব আইন রয়েছে; যেমন—সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা (নিয়মিত উপস্থিতি) অধ্যাদেশ ১৯৮২, ১৯৬৫ সালের কারখানা আইন, শ্রম আইন ইত্যাদি আমাদের মেনে চলা অত্যাবশ্যক। এ ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা ছাড়া আমরা কখনো উন্নতির সোপানে উন্নীত হতে পারব না। কেননা, যে জাতি যত নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলে, সে জাতি ততই উন্নতির শিখরে পৌঁছাইতে সক্ষম হয়। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের সার্বিক জীবনে তার প্রয়োগ তেমন একটা দেখা যায় না বললেই চলে। অবশ্য উন্নয়নশীল দেশের সর্বত্র ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা কিছুটা কঠিন বৈকি। এসব দেশে-বিদেশি শক্তি দীর্ঘদিন ধরে শাসন করার কারণে শাসকদের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি ছিল গৌণ; তাই এখনো এসব দেশ রয়েছে বিশৃঙ্খল অবস্থায়। বিদেশি শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে বারংবার বিদ্রোহ করার কারণেও বিনষ্ট হয়েছে শান্তি, স্থিতি ও শৃঙ্খলা। এর রেশ এখনো চলছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।
দীর্ঘকাল যাবৎ শৃঙ্খলা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রে একটি কথা চালু রয়েছে। বলা হয়—অর্থ, ক্ষমতা বা সামাজিক অবস্থানের ওপর সফলতা নির্ভর করে না, সফলতা নির্ভর করে শৃঙ্খলার ওপর। ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি এই কথা একটি রাষ্ট্র বা জাতির সকল কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। সেই কারণেই ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত লাল বাহাদুর শাস্ত্রী বলেছিলেন, একটি জাতির শক্তির প্রধান উৎস হলো শৃঙ্খলা। যেই জাতির শৃঙ্খলা নেই, সেই জাতি সর্বার্থেই দরিদ্র। অতএব, এই মুহূর্তে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে আমাদের অগ্রযাত্রা যে ব্যাহত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। আমরা জানি, এই জগতের সব কিছুর ভেতরেই রয়েছে এক আশ্চর্য শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য। এটাই প্রকৃতির আইন ও অন্তর্নিহিত শক্তি। দেশ ও জাতির ক্ষেত্রেও আমাদের এই অন্তর্নিহিত শক্তির কথা সর্বদা স্মরণে রাখা আবশ্যক।