হৃদয়—যা দর্শন, সাহিত্য ও অনুভূতির জগতের কেন্দ্রীয় প্রতীক—তাকে বিজ্ঞানের আলোয় নতুন দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ এনেছে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা। সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট এবং নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা সদ্যপ্রকাশিত একটি প্রবন্ধে জানিয়েছেন যে, হৃদযন্ত্রের মধ্যে রয়েছে এক ক্ষুদ্র অথচ স্বতন্ত্র মস্তিষ্ক। হৃদয়ের এই ‘ব্রেইন’ তার নিজস্ব স্নায়বিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নির্দেশ ছাড়াই নির্দিষ্ট কিছু কাজ করতে সক্ষম। এই আবিষ্কার হৃদরোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিপ্লব আনবে বলেই গবেষকগণ আশাবাদী। হৃদয়ের এই নিজস্ব স্নায়ুবিন্যাসের কারণেই তা প্রাকৃতিক পেসমেকারের মতো কাজ করে হৃদস্পন্দনের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই গবেষণার সূত্র ধরে জেব্রাফিশের ওপর পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সাইনো-আট্রিয়াল প্লেক্সাস নামক অঞ্চলটি হৃদয়ের ¯পন্দন নিয়ন্ত্রণে নিজস্ব স্নায়ুগুলোকে ব্যবহার করে, যা মস্তিষ্ক হতে সম্পূর্ণ স্বাধীন। এই স্বাধীনতার কল্যাণেই হৃদয়ের নিরন্তর ছন্দ অক্ষুন্ন থাকে।
মানব-হৃদয়ের গভীরে বিরাজমান রহস্য উদঘাটনের যাত্রা যেন নিত্য-অব্যাহত। মানব-হৃদয়ের এই অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য যেন সাহিত্যের চিরন্তন ব্যঞ্জনাকে বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি প্রদান করেছে। সাহিত্যে হৃদয় মানে শুধু অনুভূতির আধার নয়, বরং মানুষের মানসিকতার গভীরতর স্তরের প্রতিফলন। আমরা বলি ‘হৃদয় দিয়ে ভাবো’—অর্থাৎ, সহমর্মিতা ও মানবিকতার সাথে চিন্তাভাবনা করো। এর পেছনে হয়তো এই বৈজ্ঞানিক সত্যই নিহিত ছিল—যা এখন উদ্ঘটিত হয়েছে। আমাদের নিকট এই সত্য স্পষ্ট হচ্ছে—হৃদয় শুধু মস্তিষ্কের নির্দেশ মেনে কাজ করে না, তারও নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে। বর্তমান বিশ্বে, যেখানে সহিংসতা ও হানাহানির কারণে মানুষের জীবন হুমকির সম্মুখীন, সেখানে এই গবেষণা যেন একটি চমৎকার প্রতীকী বার্তা বহন করছে। আমরা যদি সত্যই হৃদয়ের মস্তিষ্ককে বিকশিত করতে পারি, তাহলে আমাদের মধ্যে সহমর্মিতা ও মানবিকতার গভীরতা বৃদ্ধি পাবে।
প্রতিটি মানুষের জীবন অমূল্য। তাকে নিজের জীবনের সমতুল্য ভেবে মূল্যায়ন করলেই সমাজে প্রকৃত শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের মধ্যে নিহিত মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তুলিতে হবে। হৃদয়ের অন্তর্গত এই ‘ব্রেইন’-এর বিকাশ মানবিক আচরণের পরিসরকে আরও উন্নত করতে পারে। মানুষের জীবন কেবল নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য নয়; বরং তা হলো, অন্যের জন্য বাঁচিবার এক মহান উপলক্ষ। হৃদয়ের সহমর্মিতা যখন বিজ্ঞানের আলোকে প্রমাণিত হয়, তখন আমরা সাহিত্যের সেই অমোঘ বাণীকে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে গ্রহণ করতে পারি— ‘সহজ মানুষ হয়ে ওঠা সবচেয়ে বড় কাজ।’
তাছাড়া, আমাদের হৃদয়ের নিজস্ব মস্তিষ্কের শক্তি যদি বিজ্ঞানসম্মত পথে অন্বেষণ করা যায়, তাহলে রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। হৃদরোগের চিকিৎসায় এর ব্যবহার মানবজীবনের গুণগত মান বৃদ্ধি করবে। একই সঙ্গে এটাও মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি আমাদের মধ্যে কিছু স্বতন্ত্র শক্তি প্রদান করেছে, যা আমরা এখনও সম্পূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পারিনি বা পারছি না।
সুতরাং, হৃদয়ের এই নতুন বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি আমাদের নিকট নিঃসেন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এটি এক দিকে যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করছে, অন্য দিকে তেমনই আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জীবনকে কেবলমাত্র যুক্তির নিরিখে বিচার করা যথেষ্ট নয়। হৃদয় দিয়ে অনুভব করার ক্ষমতা-সহানুভূতি, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা— এটিই মানবজীবনের প্রকৃত সত্তা।
মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্কের এই যুগল শক্তি যদি সঠিক পথে পরিচালিত হয়, তাহলে বিশ্ব আরও মানবিক, আরও সুন্দর হবে। সহানুভূতি ও সংবেদনশীলতার বিকাশই পৃথিবীতে শান্তি ও সুখ আনতে সক্ষম। হৃদয়ের মস্তিষ্ক আরও বিকশিত হোক, মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের আলো জ্বলিয়া উঠুক— এই প্রত্যাশার পারদ চড়তেই থাকুক। বিশ্ব হয়ে উঠুক আরও হৃদয়াশ্রিত, মানবিক।