পড়ছিলাম ফরাসি ঔপন্যাসিক, দার্শনিক সিমঁ দ্য ব্যুভুয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গ, স্বাধীন নারী প্রবন্ধটি। ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী’—যতবারই প্রবন্ধটি পড়ি, নারী সম্পর্কিত বহুল আলোচিত, গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় এই বাক্যে দৃষ্টি আটকে যায়। পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থাই নারীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে সম্মান না দিয়ে নারী অবলা, নারীকে অর্ধাঙ্গিনী রূপে গড়ে তুলেছে।
প্রাকৃতিকভাবে কেউ পুরুষ-অঙ্গ অথবা কেউ স্ত্রী-অঙ্গ নিয়ে জন্মায়। জন্মের পর এই শিশুকেই আলাদা করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। নানা মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় অর্থাত্ শিশু বয়স থেকেই পুতুল খেলা শিখিয়ে, রান্নাবাটি ধরিয়ে, চুলে ঝুঁটি বেঁধে, পোশাকে, চালচলনে ঘরের কোণে রেখে নারী করে তোলা হয়। বিভাজনটি শুরু হয় তখন থেকেই। পৃথিবীতে যত রকমের মানবিক সম্পর্ক আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ও জটিল হলো নারী-পুরুষ সম্পর্ক। শুরুতেই অবশ্য আর্থসামাজিক সম্পর্ক নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক পর্যায়ে তার ভূমিকা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। নারী-পুরুষ সম্পর্কের মূল ভিত্তি যে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং পুরুষের ওপর নারীর নির্ভরশীলতার মধ্যেই ঐতিহাসিক সামাজিকভাবেই বিদ্যমান, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে সতেরো শতক থেকে আধুনিক সমাজে নারী প্রশ্নে ইউরোপে আলোচনা এবং সীমিত পরিসরে আন্দোলন শুরু হয়। সেখান থেকেই নারী-পুরুষ সম্পর্ক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এবং তাত্ত্বিক অবদান রেখে গেছেন মেরি উলস্টন ক্রাফ্ট, জন স্টুয়ার্ট মিল থেকে ভার্জিনিয়া উলফসহ অনেকেই।
বিশ শতাব্দীর সূচনায় এই কাতারে এসে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন, সমকালের তুলনায় যার চিন্তা ছিল অত্যন্ত প্রাগ্রসর, কর্মবিমুখ সমাজে বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে অষ্টপ্রহর যিনি সুকঠোর কর্তব্যরত, কাজে ও কথায় অভেদ এমন এক নারী—রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বাংলার নারীমুক্তি আন্দোলনে বিশ শতাব্দীর সূচনায় তিনি যে বিশেষ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন, এ কথা অনস্বীকার্য। ১৯০৪ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে রোকেয়া অবরোধের দারুণ যন্ত্রণায় লিখেছেন পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে। ‘কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলন করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে।’ সেকালের এই বলিষ্ঠ কণ্ঠ আর কোথাও শোনা গেছে বলে জানা নেই। তবে ভাবতে অবাক লাগে, ১০০ বছর পর আজ এরকম উক্তি সহজ নয়।
স্ত্রী-পুরুষ প্রশ্নের মূল বিষয় হলো পুরুষের সঙ্গে নারীর অধীনতার সম্পর্ক। এই অধীনতা হলো নারীর ইচ্ছা পুরুষের ইচ্ছার অধীনস্থ থাকা। পৃথিবীতে পুরুষশাসিত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপর্যস্ত হয়েছে নারীর ন্যায়সংগত অধিকার। কারণ অধিকার ভাগ হলে তথাকথিত পৌরুষত্বের অহংকার ক্ষুণ্ন হয়। রোকেয়া নারীর এই অধিকারসচেতনতার কথাই বলেছেন আজীবন। বুদ্ধিজীবী, লেখক ও কর্মী—এই তিন রূপেই তার বিকাশ হয়েছিল নারী জাগরণের লক্ষ্যে। তিনি ক্রমাগত লিখে গেছেন মুসলিম সমাজের অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে, অশিক্ষার বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। স্কুল প্রতিষ্ঠা, নারী কল্যাণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা—এসব তার কর্মের পরিধি। তিনি মূলত নারীকে দাসত্বের শিকল থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন।
নারী-পুরুষের সম্পর্ক বিবেচনায় রোকেয়া দেখিয়েছেন এই সম্পর্কের সঙ্গে ক্রীতদাস ও দাস মালিক সম্পর্কের অনেক মিল আছে। এই উভয় সম্পর্কের মধ্যে আইনগত পার্থক্য যেমনই হোক, মানসিক দিক দিয়ে তাদের মধ্যেকার ঐক্য এক বাস্তব সত্য। দাস-মালিক সম্পর্কের মধ্যে যে অসমতা, সেই অসমতার উপাদান নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অল্পবিস্তর বিদ্যমান। নারীর ইচ্ছা পুরুষের ইচ্ছার অধীনস্থ হওয়ার মূল কারণ পুরুষের ওপর নারীর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার মধ্যেই নিহিত। আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে কর্মজীবী নারীও পুরোপুরি স্বাধীন নন।
রোকেয়া এভাবেই নারীদের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, স্বাধীনতা অর্থে পুরুষের মতো উন্নত অবস্থা বুঝতে হবে। নারীকে সাহস দেওয়ার জন্য ‘সুলতানার স্বপ্ন’ চড়িয়ে দিয়েছেন নারীর অবরুদ্ধ চেতনায়। আজ নারী কোথায় নেই? পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। সব ধরনের কর্মস্থলে নারীর অংশগ্রহণ এখন চোখে পড়ার মতো। রাজনীতিতেও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। নারীর এই এগিয়ে যাওয়া পরিবার ও সমাজের মধ্যে নানা পরিবর্তন এসেছে, যা দেখলে সত্যিই ভালো লাগে। গর্বে বুক ভরে ওঠে। নারী তার আপন মেধা-যোগ্যতায় স্থান করে নিয়েছে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে। অবরোধবাসিনী নারীর এখন সর্বত্র জয়জয়কার। ‘যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে’—এই প্রবাদ এখন সত্য হয়ে উঠেছে। ‘সুলতানার স্বপ্ন অবারিত’ সেই অভিযাত্রায় নিশাত মজুমদারের হিমালয় জয় থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা নাসা থেকে ‘ইনভেন্টর অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বাংলাদেশের মাহমুদা সুলতানা। বৈশ্বিক বিচারে বাংলাদেশের নারীর সাফল্য এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ঈর্ষণীয়। তারা পথ দেখাচ্ছেন অন্য নারীদের। অদম্য আলোকিত নারীরা এভাবেই একে একে বুনছেন তাদের স্বপ্নের জগত্। রোকেয়া তো নারীর এরকম অবস্থানই দেখতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় চাঁদের আলো অমাবস্যায় ঢেকে দিচ্ছে! দেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকলেও নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলছে, যা নারীর অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত হতাশা ও লজ্জার। সম্প্রতি বিবিএসের এক জরিপে প্রকাশ ৭০ শতাংশ নারী তাদের জীবনসঙ্গী বা স্বামী কর্তৃক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গত এক দশকের দেশে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮.৫ শতাংশে। জরিপে চার ধরনের সহিংসতা তুলে ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে শারীরিক সহিংসতা, যৌন সহিংসতা, অর্থনৈতিক সহিংসতা ও মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা। এর ভেতর যৌন সহিংসতাই সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে লক্ষ করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। এরকম একটি অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমরা নারী দিবস পালন করছি!
নারীকে দুর্বল ভাবা, তাকে ভোগের বস্তু ভাবার মতো দৃষ্টিভঙ্গিই নারীর ওপর চড়াও হতে প্রেরণা জোগায়। এক্ষেত্রে আছে আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাব, বাস্তবায়নেও আছে দুর্বলতা। ফলে ভুক্তভোগী আইনের দ্বারস্থ হতে আগ্রহ হারায়। বিপজ্জনক এই অবস্থা থেকে নারীকে সুরক্ষা দেওয়া যেমন রাষ্ট্রের কর্তব্য তেমনি সামাজিকভাবেও মানবিক মূল্যবোধ জাগাতে হবে। নারী দিবস একটি দিনের জন্য নয়, মানবিক সমাজে নারীর জন্য প্রতিদিন হোক সম্মানের।
লেখক : কথাসাহিত্যিক