পাঁচটি মুদ্রার বাস্কেটকে স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর)-এর মান বা মূল্য বলা হয়। এসডিআর হলো ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ অ্যাসেট। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর এসডিআর-এ যুক্ত আছে ইউএস ডলার, ইউরো, চাইনিজ রেনমেনবি, জাপানিজ ইয়েন, পাউন্ড স্টারলিং। এ মুদ্রাগুলো দিয়ে পরিচালিত হয় বৈদেশিক বাণিজ্য। একমাত্র আইএমএফ নিজে এবং আইএমএফের সদস্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসডিআর সংরক্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। এ মুদ্রাগুলোর মধ্যে মার্কিন ডলারের আধিপত্য বেশি।
আইএমএফের তথ্য মোতাবেক, ২০২৩-এর মার্চ মাস পর্যন্ত ১৪৯ দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রেকর্ড করা হয় ১২ হাজার ৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। এর মধ্যে ডলার রয়েছে ৫৯ দশমিক ০২ শতাংশ। এ থেকে বলা যায় যে, মার্কিন মুদ্রা ‘ডলার’ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখনো সারা বিশ্বে রাজত্ব করছে। বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা হয় মার্কিন ডলারে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের মধ্যে মার্কিন ডলারের অংশ ৮০ শতাংশের ওপর। এজন্য বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা জরুরি। কিন্তু, বৈদেশিক মুদ্রা বাজার বিগত আড়াই বছর ধরে অস্থিতিশীল অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরে ডলার-সংকটে ভুগেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থাৎ, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা বাজার এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ডলার বিক্রি করা হয় ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন, ২০২২-২৩ এ ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন, ২০২৩-২৪-এ ১২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন; অর্থাৎ, ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য ৩৪ বিলিয়ন ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিক্রি করা হয়। এ পদক্ষেপের সুফল পাওয়া যায়নি। ডলারের বাজার অস্থিরতার কারণে এবং ডলারের বিনিময় হারে ঊর্ধ্বগতির জন্য একদিকে রিজার্ভ ক্ষয় হয়েছে, টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে এবং অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। এর খেসারত এখন দিতে হচ্ছে। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে যখন বৈদেশিক মুদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, তখন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য পন্থা অবলম্বন করে।
ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশকে। এ পদ্ধতিও ফলপ্রসূ হয়নি। ক্রলিং পেগ চালু রাখার জন্য আইএমএফ বারবার চাপ দিচ্ছে অনেক আগে থেকে। এমনকি আইএমএফ থেকে পাওয়া ঋণের শর্ত হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল থাকতে হবে। অবশেষে আইএমএফ ডলার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করার নির্দেশনা দেয়। এ নির্দেশনা মেনে বিগত বছরের মে মাস থেকে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করা হয়। এ সময় ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকা থেকে ১১৮ টাকায় উঠে যায়। ক্রলিং পেগ হলো স্থির বিনিময় হারের একটি পদ্ধতি মাত্র; অর্থাত্ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ডলারের বিনিময় হার ওঠানামা করবে।
ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্ত নিলে আমি এর বিরোধিতা করেছিলাম। এমনকি এ নীতির বিরোধিতা করে গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছিলাম। যখন একটা অর্থনীতি সংকটের ভেতর দিয়ে যায়, তখন অর্থনীতিতে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি সফল হতে পারে না। বিশ্বের অনেক দেশ এ নীতি অনুসরণ করার কিছু সময় পর এ নীতি থেকে সরে এসেছে। আইএমএফ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, বিশ্বের ভালো অর্থনীতির কোনো দেশই বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ক্রলিং পেগের চর্চা নেই। তবে কিছু দেশ—উরুগুয়ে, একুয়েডর, বতসোয়ানা, কোস্টারিকা, ভিয়েতনাম, নিকারাগুয়া, আর্জেন্টিনা ক্রলিং পেগ নীতি অনুসরণ করছে। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক দেখে বলা যায় যে, ক্রলিং পেগের সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল ছিল। এখন এ ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বের হয়ে আসতে হবে।
বৈদেশিক মুদ্রা বাজার অস্থিতিশীল হতে শুরু করে ২০২১ সালের শেষ সময় থেকে। ডলারের বিনিময় হার ২০২২ সালের শুরুতে ছিল মাত্র ৮৫ টাকা। এটা এখন খোলা বাজারে (কার্ব মার্কেট) ১২৯ টাকায় উঠেছে। সরকার পরিবর্তনের পর নতুন গভর্নর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দেয় নানা কারণে। এটা ভালো সিদ্ধান্ত। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ডলারের বিনিময় হার ১২০ টাকায় নির্ধারণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে আড়াই শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামার অনুমতি দেয়। এত করে বাড়তে থাকে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স।
২০২৩ সালের চেয়ে ২০২৪ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ২২ শতাংশ। ২০২৩-এ রেমিট্যান্স এসেছিল ২১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার আর ২০২৪-এর ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসেছে ২৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। প্রবাসী বান্ধব বিনিময় হার নির্ধারণ করার কারণে রেমিট্যান্স বেড়ে গেছে। এটা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। এর পরও বছর শেষে ব্যাংকগুলোতে ডলার-সংকট দেখা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক, ২০২৪-এর ডিসেম্বরের মধ্যে বৈদেশিক দেনা পরিশোধ করতে হবে। অতি সম্প্রতি, ‘মুডিস’ কর্তৃক বাংলাদেশের ঋণমান কমার কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অনেক প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
বিলম্বে আমদানি বিল পরিশোধ করা নিষেধ ছিল। অফশোর ব্যাংকিং ঋণের আন্তঃপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। এছাড়া রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে একচেটিয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। বলা প্রয়োজন যে, রিয়েল ইফেকটিভ একচেঞ্জ রেট (রিয়ার) বেড়ে যাচ্ছে। বিগত বছরের অক্টোবর রিয়ার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০২ দশমিক ৯৭। রিয়ার হলো মুদ্রার ভারসাম্য মান (ভ্যালু) নির্ণয় করার একটি পদ্ধতি। রিয়ার ১০০-এর ওপর থাকলে রপ্তানি প্রতিযোগিতা থাকে না। রিয়ার ১০০ হলে রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়ের জন্য ইতিবাচক।
ক্রলিং পেগ-নীতি থেকে বের হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটাকে স্বাগত জানাই; অর্থাত্, ডলারের দাম ওঠানামা করবে বাজারে ডলারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে। প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স ১২৩ টাকায় ক্রয় করা যাবে। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে আমদানি দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে নিলামের মাধ্যমে ডলার বিক্রি করবে। আমি এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছি। কারণ, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি এখন চলমান। এ কর্মসূচির আওতায়, রিজার্ভে ডলার মজুতের একটা শর্ত দেওয়া আছে। আর এ শর্ত পূরণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো ডলার কিনছে। ২০২৫ সালের মার্চ শেষে নিট রিজার্ভ থাকতে হবে ১৬ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার।
২০২৬ সালের শেষে থাকতে হবে নিট ১৭ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। যেটি আগে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ১৯ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। অবস্থা বিচেনা করে কমানো হয়েছে। বাংলাদেশিদের জন্য প্রবাসী বাজার সংকুচিত হচ্ছে। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ৯৭ শতাংশ কর্মীই গেছেন মাত্র ১০ দেশে। আবার রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে পারিনি। এ থেকে বলা যায় রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় টেকসই নয়। এর ওপর নির্ভর করে রিজার্ভ দাঁড়িয়ে আছে। রিজার্ভ যেনতেনভাবে ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত হবে না। বাজেট সহায়তার জন্য আইএমএফের কাছ থেকে আরো ঋণসহায়তা নিতে হবে। রিজার্ভের শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হলে সামনের দিন আইএমএফ থেকে সহযোগিতা পাওয়া কঠিন হবে।
একটা উদীয়মান অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল রাখা অত্যন্ত জরুরি। যেটা বাংলাদেশে আড়াই বছর ধরে স্থিতিশীল ছিল না। ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে। ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে এবং বাজার তদারকি বাড়ালে, আইন ভঙ্গকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে বৈদেশিক মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল হতে বাধ্য। পরিশেষে বলতে চাই, মার্কিন ডলারের আয়ের পথ বাড়াতে না পারলে বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি এক্সচেঞ্জ