ট্রাম্পের অধীনে পরবর্তী চার বছরে বৈশ্বিক পরিস্থিতি কেমন হবে—তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে বর্তমান পরিস্থিতি যে রাতারাতি পালটে যাবে না—ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি ও তার নিরাপত্তা দল এমন কিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাদের প্রায় সবাই ট্রাম্পবাদ ও মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন—(মাগা)-এর দৃঢ় সমর্থক। মাগা ১.০, যা ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আমরা দেখতে পেয়েছিলাম, মূলত অতিরিক্ত বাস্তববাদ এবং বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন ছিল।
ট্রাম্প গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে আধিপত্যবাদী সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন এবং উদীয়মান শক্তিগুলোর চাহিদাগুলোকে শুধুমাত্র আমেরিকান বাস্তববাদের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। ট্রাম্পের দলের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, ঐতিহ্যবাহী নব্য-রক্ষণশীল ধারা থেকে তারা বহুলাংশে আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে মনোনীত পিট হেগসেথ এমন একজন ব্যক্তি, যিনি ঐতিহ্যবাহী মার্কিন নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা প্রশাসনের বাইরে কাজ করেছেন। তিনি একজন জায়োনিস্ট এবং বিশ্বাস করেন, ‘জায়োনবাদ’ ও ‘আমেরিকানিজম’ হলো পশ্চিমা সভ্যতা ও স্বাধীনতার প্রথম সারির প্রতিরক্ষা কবচ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মনোনীত মার্কো রুবিও কোনো আন্তর্জাতিক কূটনীতির অভিজ্ঞতা ছাড়াই দায়িত্ব পেয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে মনোনীত মাইক ওয়াল্টজ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইসরায়েলকে একটি ব্ল্যাঙ্ক চেক দেওয়া, অর্থাৎ, ইসরাইলের যত টাকা প্রয়োজন সব যুক্তরাষ্ট্র দেবে। তার দলের অন্যান্য সদস্যরাও একই মতাদর্শে বিশ্বাসী।
ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাদের পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে বাকি বিশ্বের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, সেটি অনুধাবন করা। এর জন্য ব্যক্তিগত প্রোফাইলের পরিবর্তে পররাষ্ট্রনীতির কাঠামোগত উপাদান বিশেষণ করা প্রয়োজন।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যু ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটা। ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা দল ইসরায়েলপন্থী হলেও, এর মানে এই নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে অসংখ্য পথ খোলা রয়েছে। ইসরায়েল তথাকথিত আত্মরক্ষার যুদ্ধে জয়লাভ করতে যাচ্ছে এটা বলা যায় না। তারা এখন এমন কাজ করার চেষ্টা করছে যা আরও বড় আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। গাজায় অমানবিক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়া, পশ্চিম তীর দখল করার পাশাপাশি দক্ষিণ লেবানন দখল করার মতো কাজ ট্রাম্পের প্রো-ইসরায়েল প্রশাসনও ইসলায়েলকে বিনা বাধায় চালিয়ে যেতে দেবে না।
অন্যদিকে, সিরিয়ায় ইরানের প্রক্সি বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করা ও ইরানকে দুর্বল করার মতো লক্ষ্য ইসরায়েলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থন দিয়েও অর্জন করা সম্ভব নয়। আঞ্চলিক সংঘাত প্রতিরোধে আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সমন্বয় প্রয়োজন। আর আঞ্চলিক সংঘাত প্রতিরোধ করার দায়িত্ব মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ওপরে এসেই পড়ে। ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া সমর্থন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা আনবে না বরং এটা মধ্যপ্রাচ্যকে আরও বেশি বিশৃঙ্খল করে তুলতে পারে। ইসরায়েলের প্রতি সীমাহীন মার্কিন সমর্থন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা থেকে মার্কিন বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি করবে এবং ইসরায়েল-নির্ভর মধ্যপ্রাচ্য নীতির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি সমালোচনার শিকার হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা শুধুমাত্র ইসরায়েলের ক্ষেত্রেই নয়। ইরান ইসরায়েলের চেয়ে দুর্বল হতে পারে, তবে তার আঞ্চলিক সংঘাতের ক্ষমতা হারিয়ে যায়নি। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম মোকাবেলা না করে সামরিক উপায়ে নীতি পরিবর্তনের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হলে ইরান আরও আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে উপসাগরীয় দেশগুলো আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা আরও বৃদ্ধি পাবে। ইরানের প্রতি বাস্তবসম্মত ও কার্যকর নীতির জন্য এখন পারমাণবিক আলোচনায় ফিরে আসার বিকল্প তৈরি এবং একটি আঞ্চলিক ঐক্য গঠন করা প্রয়োজন। কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও অতিরিক্ত শক্তি প্রদর্শন ইরানকে দুর্বল না করে বরং তাকে আগ্রাসী আচরণের জন্য উস্কে দেবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্যে রাশিয়া অন্যতম, যা কৌশলগত ও পদ্ধতিগত প্রভাবের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে সহজে হারবে না এবং এই মুহূর্তে যুদ্ধবিরতির জন্য রাজি নয়। উপরন্তু, ট্রাম্প প্রশাসনের ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থায়নে অনীহা রাশিয়ার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে এবং ইউরোপকে রাশিয়ার তুলনায় দুর্বল অবস্থানে ঠেলে দেয়।
ঐকমত্যের ভিত্তিতে শান্তি পরিকল্পনা তৈরি করার একমাত্র উপায় হলো রাশিয়ার গ্রহণযোগ্য শর্তে ইউক্রেন সংকট পুনমূর্ল্যায়ন করা। রাশিয়ার বলয় থেকে সরে যাওয়ার জন্য নতুন একটি সমঝোতার বিকল্প নিয়ে কাজ করতে হবে। ট্রাম্পের সামরিক প্রতিরোধের ভিত্তিতে আলোচনাভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি ইউক্রেনের যুদ্ধে ইতি টানতে পারবে কি?
ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা বিসর্জন দিয়ে যুদ্ধ শেষ করলে ট্রাম্প কৌশলগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন, যেমন ইউরোপের ওপর প্রভাব হারানো ও ন্যাটো দুর্বল হয়ে যাওয়া, যা বৈশ্বিক ব্যবস্থায় তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য নতুন কৌশলের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
চীন ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে। তবে চীনের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের সরলীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি, যা ওবামা-যুগ থেকে ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে, চীনের সমস্যাকে আরও গুরুতর করে তুলতে পারে। ট্রাম্পের দেশীয় অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের পরিবর্তে চীনকে অর্থনৈতিকভাবে চেপে ধরলে পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ ধারণ করতে পারে। চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং বিচ্ছিন্নকরণ নীতি ট্রাম্পের বৈশ্বিক নেতৃত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং চীনের নতুন মিত্র গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটকে উস্কে দিতে পারে এবং দুর্বল ও ভঙ্গুর অর্থনীতিকে চীনের প্রতি আরও বেশি নির্ভরশীল করে তুলতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা করবে তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো মার্কিন নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বের অন্যান্য দেশ কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে। আগামী চার বছরে বৈশ্বিক রাজনীতির হালচাল আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা এড়াতে, ট্রাম্পের উচিত একটি সহযোগিতামূলক পররাষ্ট্রনীতি এবং নিরাপত্তা পদ্ধতি গ্রহণ করা, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে প্রতিদ্বন্দীমূলক পরিবেশের পরিবর্তে সহযোগিতামূলক বিশ্বের দুয়ার খুলে দেবে।
লেখক: মুরাত ইয়েসিলতাস।
ইয়েসিলতাস সোশ্যাল সাইন্সেস ইউনিভার্সিটি অব আঙ্কারার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক
ডেইলি সাবাহ থেকে অনুবাদ: আব্দুল্লাহ আল মামুন