মানুষ কী চায়? মানুষ চায় ভয়ভীতিমুক্ত একটি নিরাপদ জীবন। নিরুপদ্রব জীবন। মানুষের এই চাওয়া বহু প্রাচীন। মানুষ মূলত সভ্যতা তথা সমাজ-রাষ্ট্র গঠন করেছে স্বস্তিময় জীবন যাপনের জন্যই। যদি কোথাও মানুষ ভয়ভীতিমুক্ত স্বস্তিদায়ক নিরাপদ জীবন না পায়, তখন সেই জনপদের জন্য তা লজ্জার কারণ হয়ে ওঠে।
ভয়ভীতিমুক্ত জনপদের জন্য রাজনৈতিক উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। দার্শনিক টমাস হবস বলেছেন, ‘মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বার্থপর এবং নিষ্ঠুর, তবে রাষ্ট্র তার ওপর নিয়ম আরোপ করে তাকে শৃঙ্খলিত করে রাখে।’ কাজেই, রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ভঙ্গ হলে মানুষের ভয়াবহ অবস্থা নির্ধারিত। আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী তথা দার্শনিক ইয়োশিহিরো ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা তার প্রভাবশালী গ্রন্থ ‘অরিজিনস অব পলিটিক্যাল অর্ডার’-এ বলেছেন যে, রাজনৈতিক উন্নয়ন হলো তিনটি দিকের মধ্যে স্থিতিশীল ভারসাম্য। এ তিনটি দিক হলো—রাষ্ট্রনির্মাণ (স্টেট বিল্ডিং), আইনের শাসনের সুসংহতকরণ (কনসলিডেশন অব রুল অব ল) এবং গণতন্ত্রে উত্তরণ (ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশন)। এর ব্যত্যয় ছিল আঠারো-উনিশ শতকের ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোতে। মূলত ভয়শূন্য, মুক্তজ্ঞানের নিরুপদ্রব জীবনের প্রত্যাশায় আঠারো-উনিশ শতকে ইউরোপের স্বাধীনচেতা, মেধাবী, দক্ষ ও শিক্ষিতরা আমেরিকায় ছুটিয়া যেত। আর ইউরোপ হতে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত এই সকল মেধাবী, স্বাধীনচেতা, শান্তিপ্রিয়, উচ্চভিলাষী, উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের সম্মিলিত প্রয়াসে গড়ে উঠেছে ভয়ভীতিমুক্ত অবাধ মতপ্রকাশের এক অপূর্ব রাষ্ট্র।
বহু বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন—চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,/ জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর/ আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী/ বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,’। এখানেও মূল কথা হলো, ভয়শূন্য মনে, উচ্চশির, মুক্ত জ্ঞানের জগতই মানুষ কামনা করে। প্রকৃতপক্ষে, ভয়ভীতিমুক্ত শান্তিময় জীবন প্রতিটি মানুষই চায়। যিনি ছোট্ট কুঁড়েঘরে থাকেন, তিনিও শান্তি চান, যিনি আলিশান অট্টালিকাবাসী, তিনিও শান্তির অন্বেষণ করেন। অর্থাৎ শান্তি ধনী-নির্ধন—সবাই চান। শান্তি হলো দুইটি বিষয়ের সমন্বয়। এর একটি হলো—নিরাপত্তা, অন্যটি হলো আমাদের মানসিক দিক। ইংরেজিতে একে বলা হয়—পিস অব মাইন্ড ইজ এ মেন্টাল স্টেট অব কামনেস অর ট্রাংকুয়িলিটি। এটা হলো উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা হতে মুক্তি পাওয়া। মানুষ যেহেতু তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যেই বেড়ে ওঠে, সুতরাং এই তিন স্তরের ভালো বা খারাপ জিনিসগুলোই তাদের জীবনকে গড়ে দেয়। এখন প্রতিদিনই খবরের কাগজ খুলে তৃতীয় বিশ্বের ছেলেমেয়েরা যদি দেখে—আমাদের পরিবার, সমাজে ও রাষ্ট্রে অসংখ্য ঘৃণ্য অপরাধমূলক কাণ্ডকারখানা দিনের পর দিন ঘটে চলছে এবং তার লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না—তাহলে এই সংবেদনশীল ছেলেমেয়েরা ভব্যিষ্যতের আয়নায় কী দেখতে পাবে?
প্রকৃত অর্থে, স্বাধীনতার আনন্দ মানুষ তখনই পায়—যখন তা ভয়মুক্ত হয়। সমাজ-রাষ্ট্রের প্রকৃত সাফল্য পরিমাপ করতে হলে তার নাগরিকদের নিরাপত্তা ও শান্তি বিবেচনা করাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, প্রাজ্ঞ মানুষ যে কোনো মূল্যে ভয়ভীতিমুক্ত নিরাপদ নিরুপদ্রব জীবন যাপন করতে চায়। এমন একটি সমাজ গড়ে তোলাই প্রতিটি সভ্য রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। সুতরাং সময় এসেছে, আমাদেরও একটি উচ্চশিরের ভয়শূন্য চিত্তের কল্যাণকর রাষ্ট্র বিনির্মাণ করার। মানুষের ভয়ভীতিমুক্ত জীবনের আকাঙ্ক্ষা সভ্যতার শেকড়। এই শেকড়ের প্রতি যত্নবান হতে হবে। নচেৎ সভ্যতা কখনো মহিরুহ হতেও পারবে না, আমাদের মাঝে শান্তির ছায়াও দিতে পারবে না।