বাংলাদেশে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি যুদ্ধে লাখ লাখ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে, যেখানে একটি সিটের বিপরীতে ন্যূনতম ১০ জন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী লড়াই করে। একদল শিক্ষার্থী ভর্তিযুদ্ধে সফল হয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায় আর অন্য দলকে টানতে হয় ব্যর্থতার ঘানি। তবে কি কোনো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারলে সে অসফল? উত্তর হচ্ছে না!
অথচ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেলে তথাকথিত সুশীল সমাজ তাকে ব্যর্থ হিসেবেই চিহ্নিত করে। তাদের ধ্যানধারণা হলো—সাফল্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাদের এই বিকৃত মানসিক তৃপ্তির খোরাক হয়ে হতাশায় ভুগে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধে পরাজয় বরণ করা লাখ লাখ শিক্ষার্থী। এমনকি সফলতার সংকীর্ণ বেড়াজালে আটকা পড়ে অকালে ঝরে যায় বহু সুন্দর সম্ভাবনাময় তারুণ্য!
এই প্রবণতা কেবল শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, বরং পুরো জাতির জন্যই ক্ষতিকর। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হতে না পারার মানে এই নয় যে, সে শিক্ষার্থী ব্যর্থ বা তার ভবিষ্যত্ অন্ধকার। বরং, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি, তারা নিজের পছন্দ এবং দক্ষতা অনুসারে অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে। কেউ উদ্যোক্তা হয়, দক্ষ কারিগরি কাজের সঙ্গে যুক্ত হয় কেউ কেউ, কিংবা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে অন্য কোনো পেশায়। এগুলোও সফলতার জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ দিক নয়।
আমাদের সমাজের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, একটি শুদ্ধ মানুষ বা সফল মানুষ শুধু সেই ব্যক্তি, যিনি এক বা একাধিক ডিগ্রি অর্জন করেছেন, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এই সংকীর্ণ মানদণ্ডের কারণে বহু শিক্ষার্থী মনে করে, তাদের জীবনের লক্ষ্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া এবং ডিগ্রি অর্জন করা। এই ভয়াবহ ও দুঃখজনক বাস্তবতা আমাদের সমাজের মানসিক অস্থিরতা এবং অসম্পূর্ণ মানসিকতার ফলাফল।
সফলতা কোনো একক পথের ওপর নির্ভর করে না। সফলতা অর্জন করতে হলে এক জন মানুষকে তার আত্মবিশ্বাস, পরিশ্রম, দক্ষতা এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বাইরেও অনেক ক্ষেত্রেই এমন শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা তাদের প্রতিভা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে জীবনে অসাধারণ কিছু অর্জন করেছে। অর্থাত্, একজন শিক্ষার্থী যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে না ভর্তি হতে পারে, তবে তাকে ব্যর্থ হিসেবে চিহ্নিত করা একেবারেই অযৌক্তিক।
আমাদের উচিত, সামাজিক মানদণ্ডের মধ্যে আটকে না থেকে বরং প্রতিটি শিক্ষার্থীকে তার নিজের পথ খুঁজে বের করার সুযোগ করে দেওয়া। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে, যাতে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লেও তাকে মূল্যায়ন করা হয় তার আত্মবিশ্বাস, উদ্যোগ এবং মানবিক গুণাবলির জন্য।
একজন শিক্ষার্থী যেন নিজের ভালোবাসা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে পেশাগত জীবন শুরু করতে পারে, সে জন্য সরকারের এবং সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে একটি বৈচিত্র্যময় এবং উদার সমাজ গড়ে তোলার কাজও সহজ হয়ে উঠবে। মনে রাখতে হবে, সাফল্য শুধু ডিগ্রি অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সঠিক পথ অনুসরণ এবং নিজের লক্ষ্য পূরণের মধ্যে নিহিত।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়