সব ধরনের উন্নয়নের মূলে রয়েছে শিক্ষা; এ দিকটি আমাদের অনুধাবন করতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। শিক্ষাকে অবহেলা করে কোনো জাতি কখনোই উন্নয়নের শীর্ষে আরোহণ করতে পারে না। দেশের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন করতে হলে শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে; শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি—এটা আর নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। পরিতাপের বিষয়, শিক্ষার উন্নয়নের জন্য সরকারি পর্যায়ে গৃহীত অনেক প্রকল্পে এখনো আমাদের বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয়ে বৈদেশিক পরামর্শক (Consultant) নিয়োগ করতে হয়!
উন্নত দেশগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, ঐ সব দেশ শিক্ষাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সেসব দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবেই শিক্ষকদের যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হয়। আর আমাদের দেশে শিক্ষকরা হন সবচেয়ে কম গুরুত্বহীন সামান্য বেতনের সাধারণ চাকরিজীবী। তাদের না থাকে তেমন সামাজিক মর্যাদা, না থাকে পর্যাপ্ত অর্থসম্পদ। ফলে এদেশের শিক্ষকরা সারা জীবনই চরম অবহেলার শিকার হয়ে থাকেন। শিক্ষকদের যতদিন সরকারি চাকরির বেতন-কাঠামোভুক্ত সাধারণ চাকরিজীবী করে রাখা হবে ততদিন শিক্ষার কোনো উন্নয়ন হবে না। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন করা না গেলে দেশের উন্নয়ন সুদূর পরাহত থেকে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই।

প্রশ্ন উঠতে পারে, বাজার-সিন্ডিকেটের কথা শোনা যায়, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে সিন্ডিকেট আবার কী রকম? সিন্ডিকেট শুধু বাজার বা শিক্ষাক্ষেত্রেই বিদ্যমান নয়, বরং যেসব ক্ষেত্রে আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে সেখানেই কোনো না কোনো সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। শিক্ষাক্ষেত্রে ‘বদলি-সিন্ডিকেট’ সবচেয়ে প্রভাবশালী বলে অনেকে মনে করেন। বদলি-সিন্ডিকেট সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে সরকারি কলেজসমূহে কর্মরত বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের আগ্রহী কর্মকর্তাদের কারো কারো কাছ থেকে অর্থ আদায়ের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বদলির ব্যবস্থা করে দেয়। অথচ অনেক বছর আগে থেকেই সরকারি কলেজগুলোর শিক্ষকদের বদলির আবেদন অনলাইনে দাখিলের নিয়ম চালু করা হয়েছে। তার পরও বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের প্রভাব কমেনি।
এ ছাড়া শিক্ষা বিভাগের সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে আর্থিকভাবে লাভজনক পদের ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেট টাকার বিনিময়ে পদায়নের ব্যবস্থা করে দেয় বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয় প্রায়ই। এমনকি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তিতে আর্থিক লেনদেনের বড় বড় অভিযোগের খবরও প্রকাশিত হয়। শিক্ষক-কর্মচারীদের ছুটি, অবসর-গ্রহণসুবিধা, পেনশন ইত্যাদি কাজ করাতেও অনেক সময় সিন্ডিকেটকে টাকা দিতে হয়। শিক্ষা খাতে প্রশাসনিক ও পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে এসব কথিত সিন্ডিকেট-প্রথা নির্মূল করা যেতে পারে। শিক্ষা খাতের সংস্কার প্রসঙ্গে সম্প্রতি গণমাধ্যমে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, ‘শিক্ষা নিয়ে কোনো সংস্কার কমিশন গঠনের পরিকল্পনা এ মুহূর্তে সরকারের নেই। এই খাত এখন চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। আগে শিক্ষা খাতে সব বিশৃঙ্খলা দূর করে দুর্নীতি রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এরপর শিক্ষা খাতের বরেণ্যদের নিয়ে একটি ‘শিক্ষা খাতের উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠন করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।’ শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয়ের এ বক্তব্য থেকেই শিক্ষাক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব ও দৌরাত্ম্য অনুভব করা যায়। এ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা খাতকে মুক্ত করতে সুশিক্ষা ও সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য খুব কঠিন নয় বলে মনে করি।
লেখক : অধ্যাপক। সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের