মানুষের ভালো থাকার বিষয়টি কীসের ওপর নির্ভর করে? অনেকে বলে থাকেন, ভালো থাকার ধারণাটি মূলত একজন ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ মনোভাব, চেতনাগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে সংযোগের ওপর নির্ভরশীল। এই ভালো থাকা কেবল ব্যক্তি পর্যায়েই সত্য নয়, এটা একটি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ব্যক্তিপর্যায়ে ভালো থাকা মানে শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের ভালো অবস্থান নয়; বরং এটা মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি সামগ্রিক অবস্থা। একজন ব্যক্তির ভালো থাকা তার চিন্তার ধরন, জীবনদর্শন ও পরিস্থিতির প্রতি সাড়া দেওয়ার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তি যদি নিজের জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব রাখতে সক্ষম হন এবং প্রতিকূল অবস্থাতেও শান্তি ও সুখ খুঁজে নিতে পারেন, তাহলে তার ভালো থাকা অধিকতর সম্ভাব্য। তবে, িএটা তার পরিবেশের উপরও নির্ভরশীল। যদি তার চারপাশে সহানুভূতিশীল মানুষ, সুস্থ পরিবেশ ও নিরাপত্তার বোধ থাকে, তাহলে তার ভালো থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। আমরা এক্ষেত্রে স্মরণ করতে পারি বিখ্যাত মনীষী মার্কাস অরেলিয়াসের কথা। তিনি বলেছেন, ‘যা তোমার মনকে শান্তি দেয়, তাতেই প্রকৃত সুখ নিহিত’।
এখানে প্রাচীন গ্রিক মিথের একটি গল্প অবতারণা করা যেতে পারে। রাজা মিডাস স্বর্ণের প্রতি অতিশয় লোভী ছিলেন। তিনি দেবতা ডায়োনিসের নিকট প্রার্থনা করলেন, যেন তিনি যা-ই স্পর্শ করেন, তা স্বর্ণে পরিণত হয়। প্রথমে এই শক্তি তাকে আনন্দ দিলেও, পরবর্তী পর্যায়ে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, এটা তার জীবনের প্রকৃত সুখ কেড়ে নিচ্ছে! তার খাবার, পানীয় এবং পরিবার—সব কিছু স্বর্ণে পরিণত হচ্ছে। অবশেষে, তিনি ডায়োনিসের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং তার এই শক্তি ফিরিয়ে নিলেন! রাজা মিডাসের কাহিনি আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, প্রকৃত সুখ বাহ্যিক সম্পদে নয়, এটা অন্তরের শান্তি এবং মানসিক স্থিতির ওপর নির্ভর করে। আসলে আমাদের কর্মের মধ্যেই আমাদের ভালো থাকার মূল সূত্র নিহিত থাকে। ভালো থাকা মানে আমাদের চিন্তাচেতনা কথা এবং কাজের মধ্যে সমন্বয়। এই সূত্র ধরে বলা যায়, ভালো থাকা একটি স্টেট অব মাইন্ড—যা একান্তই অভ্যন্তরীণ ও নিজস্ব। একইভাবে, রাষ্ট্রের ভালো থাকা এর জনগণের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সমন্বয় এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপর নির্ভরশীল। একটি রাষ্ট্র যখন তার নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়, তখন সেই রাষ্ট্র একটি সুস্থ ও সুখী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু এটা শুধু বাহ্যিক উপাদানের ওপর নির্ভর করে না; রাষ্ট্রের মানসিক অবস্থা তার শাসনব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৈতিক মূল্যবোধের উপরও নির্ভরশীল। যখন একজন ব্যক্তি তার সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা অনুভব করেন এবং নিজের জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, তখন তিনি সেই রাষ্ট্রের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন।
সুতরাং ভালো থাকার দায়িত্ব ব্যক্তি ও রাষ্ট্র—উভয়ের ওপর সমানভাবে বর্তায়। ব্যক্তি তার নিজস্ব মনোভাব ও আচরণের মাধ্যমে নিজের ভালো থাকার চেষ্টা করবে এবং রাষ্ট্র তার শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে সেই প্রচেষ্টাকে সহায়তা করবে। একে অপরকে পরিপূর্ণ করতে পারলে তাহলেই কেবল ভালো থাকার একটি সমন্বিত পরিবেশ তৈরি হয়। শেষাবধি ভালো থাকা একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। এটা সদা পরিবর্তনশীল ও চলমান। ব্যক্তি ও রাষ্ট্র যদি একে অন্যের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে সচেষ্ট হয়, তাহলে ভালো থাকা কেবল একটি ধারণা নয়, বরং বাস্তবতার অংশ হয়ে উঠবে। এটাই মানবজীবন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন।