আবদুল হামিদ খান—যিনি মওলানা ভাসানী নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য এবং স্মরণীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পাবনা জেলাধীন সিরাজগঞ্জ মহকুমায় (বর্তমানে রাজশাহী, বাংলাদেশ) জন্মগ্রহণকারী এই মহান নেতা, ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকায় (৯৬ বছর বয়সে) মৃত্যুবরণ করেন। টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষে তিনি চিরশায়িত।
মওলানা ভাসানী ছিলেন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য একটি অনুপ্রেরণার উৎস, বিশেষত শোষিত, নিপীড়িত এবং নির্যাতিত জনগণের অধিকার রক্ষায়। তার সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের সংগতি ছিল মানুষের মুক্তির সংগ্রাম এবং শোষণমুক্ত সমাজ গঠন। তিনি কোনো রকম সামাজিক বা ধর্মীয় বিভেদকে কখনোই গুরুত্ব দেননি, বরং সর্বদা গণমানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী ছিলেন। মওলানা ভাসানী ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, কারণ তিনি সব সময় অবহেলিত, নির্যাতিত এবং শোষিত জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে এক শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যা পরবর্তীকালে স্বাধীনতার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তার অবদান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক পথচলা ছিল দীর্ঘ, কঠিন এবং সংগ্রামী। তিনি ছিলেন একাধারে একজন ধর্মীয় নেতা, সমাজকর্মী এবং অসামান্য রাজনৈতিক কৌশলী। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মূলত তৃণমূল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল। তিনি কখনোই শাসক শ্রেণির স্বার্থে কাজ করেননি, বরং তার নেতৃত্ব ছিল সাধারণ মানুষের প্রতি আস্থাশীল। ব্রিটিশ ভারতে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী হিসেবে তিনি যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, ১৯৪৭ সালে তিনি প্রথম বিরোধী দলের নেতা হিসেবে পরিচিত হন এবং দেশের শোষক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন, যা মূলত পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি সভাপতি ছিলেন। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কৃষক ও শ্রমিকের স্বার্থ মওলানা ভাসানী ছিলেন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য একটি অনুপ্রেরণার উৎস, বিশেষত শোষিত, নিপীড়িত এবং নির্যাতিত জনগণের অধিকার রক্ষায়। তার সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের সংগতি ছিল মানুষের মুক্তির সংগ্রাম এবং শোষণমুক্ত সমাজ গঠন রক্ষায় এবং পাকিস্তান সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। তবে, কিছু রাজনৈতিক মতবিরোধ এবং রাজনৈতিক কৌশলের কারণে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন, যা একদিকে বামপন্থি আন্দোলন এবং অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে গুরুত্ব দেয়। তার নেতৃত্বে ন্যাপ শোষণবিরোধী সংগ্রামের একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফরম হিসেবে আবির্ভূত হয়।
মওলানা ভাসানী ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই ফ্রন্ট ছিল পাকিস্তানে শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধের প্রতীক। তার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোতে শক্তিশালী প্রতিবাদ গড়ে তোলে, যা শোষক সরকার এবং তার দমন-পীড়নমূলক নীতির বিরুদ্ধে এক ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ। ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন ছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি তার অঙ্গীকারের প্রতীক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের জাতীয়তা ও সংস্কৃতির এক মহান দ্বার উন্মোচন, যেখানে মওলানা ভাসানী জনগণের অধিকারের পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেন।
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গণঅভ্যুত্থান ছিল পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের ঐতিহাসিক প্রতিবাদ, যেখানে মওলানা ভাসানী তার অঙ্গীকার অনুযায়ী শোষিত জনগণের পাশে দাঁড়ান। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তিনি পাকিস্তান সরকারের শোষণমূলক নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন এবং দেশের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন।
ভাসানী ছিলেন এমন এক নেতা, যার মধ্যে একাধারে বামপন্থি এবং ইসলামি চিন্তাধারার মিশ্রণ ছিল। তাকে ‘লাল মওলানা’ নামেও ডাকা হতো, কারণ তিনি মাওপন্থি ছিলেন এবং তার জীবনব্যাপী লক্ষ্য ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন পরিবর্তন চান, তেমনি তিনি ইসলামি নীতির আলোকে সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিলেন। তার রাজনৈতিক দর্শন ছিল চেয়েছিলেন এবং শোষকদের বিরুদ্ধে সবারই একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
ভাসানী শুধু ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন না, বরং মানবাধিকার, সমাজতন্ত্র এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান ছিল, যা তাকে গণমানুষের নেতায় পরিণত করেছিল। মওলানা ভাসানীর ১৯৭৬ সালে লংমার্চের নেতৃত্ব দেন, যা ছিল বাংলাদেশের জনগণের ঐকা জনগণের উন্নতি এবং শোষণমুক্ত সমাজ গঠন। তিনি মনে করতেন যে, শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেই সমাজের পরিবর্তন সম্ভব।
মওলানা ভাসানী বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকার কেবল একটি জাতির অগ্রগতির দিশা নয়, বরং এটি আধ্যাত্মিক আদর্শও হতে পারে। তিনি জনগণের স্বার্থে কাজ করতেন এবং সব সময় শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতেন। মওলানা ভাসানীর অন্যতম উল্লেখযোগ্য বক্তব্য ছিল, ‘হিন্দুর ক্ষুধা, মুসলমানের ক্ষুধা, বৌদ্ধের ক্ষুধা, খ্রিষ্টানের ক্ষুধা একই রকম। শোষক ও জালেমের কোনো ধর্ম নেই। মজলুমের কোনো ধর্ম নেই। জালেম হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক, দেশি হোক আর বিদেশি হোক, কালো চামড়ার হোক আর সাদা চামড়ার হোক-সব সমান।’ এই বক্তব্যটি ছিল তার জীবনদর্শনের প্রতিফলন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শোষণ এবং অত্যাচারের শিকার মানুষের প্রতি সহানুভূতি এবং সমবেদনা একটি মানবিক কর্তব্য, যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণির সীমানা ছাড়িয়ে যায়।
ভাসানী তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এই ধারণাকে বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করেছেন। তিনি সব ধরনের শোষণ, ধর্মীয় বা জাতিগত বিভেদকে অস্বীকার করেছেন এবং শোষিত মানুষের জন্য ন্যায় ও সাম্যের সংগ্রামে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে সমতার ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে ও সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। ভাসানীর এই লংমার্চ শুধু পানি সংকটের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং এটি ছিল বাংলাদেশের জনগণের ঐক্য ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতীক। ভাসানী বিশ্বাস করতেন যে, একটি স্বাধীন বাংলাদেশে সমৃদ্ধি, শান্তি এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, তবে তার জন্য একত্রিতভাবে সব স্তরের জনগণকে সংগ্রাম করতে হবে। তিনি জাতীয় স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন।
মওলানা ভাসানী যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই বাংলাদেশ আজও বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মওলানা ভাসানী ছিলেন একজন বহুমাত্রিক নেতা, যার চিন্তাভাবনা এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথকে আলোকিত করেছে। ভাসানীর মৃত্যু পরেও, তার চিন্তা-দর্শন, আদর্শ এবং সংগ্রামী জীবন আজও আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল সংগ্রাম ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, যা আজও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে প্রভাব ফেলে। ভাসানীর নাম এবং তার কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে আমরা যেমন তার মৃত্যুর দিনটিতে তাকে স্মরণ করি, তেমনি তার আদর্শ এবং মূল্যবোধ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করি।