আজ পবিত্র শবেবরাত। ফারসি শব্দ ‘শব’ অর্থ রাত্রি, আর বরাত অর্থ মুক্তি; অর্থাৎ শবেবরাত অর্থ মুক্তির রজনি। আরবিতে একে বলা হয় ‘লাইলাতুল বারাআত’। এর অর্থও একই—অর্থাৎ ‘মুক্তির রাত্রি’। হিজরি সালের অষ্টম মাস শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রিকে শবেবরাত বলা হয়। পবিত্র কুরআন শরিফে লাইলাতুল কদরের কথা সুস্পষ্ট বলা হয়েছে। এমনকি সুরাতুল কদর নামে এ সম্পর্কিত একটি স্বতন্ত্র সুরাও রয়েছে; কিন্তু আল কুরআনে লাইলাতুল বারাআতের কথা বলা হয়নি। এর প্রসঙ্গটি এসেছে আসলে হাদিস শরিফে। হাদিসের পরিভাষায় এর নাম ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’, তথা ‘মধ্য-শাবানের রজনি’। এ রাত্রির তাৎপর্য সম্পর্কে হাদিসে বলা হলেও তাকে উপেক্ষা করার কোনো কারণ নেই। মূলত মহিমান্বিত রাত্রিসমূহের অন্যতম হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’।
ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, এ রাতে মহান আল্লাহ তার বান্দাদের ক্ষমা করেন, দোয়া কবুল করেন এবং অনুগ্রহ প্রদান করেন। এজন্য বিশেষ এই রাতটি মুসলিম বিশ্বে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে পালন করা হয়। এ রাত সম্পর্কে একটি সহিহ হাদিস পাওয়া যায় সুনানে ইবনে মাজাহ্-এর ইকামাতুস্ সালাত অধ্যায়ে। হজরত আবু মুসা আশয়ারি (রা.) হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ মধ্য-শাবানের রাতে সমস্ত সৃষ্টির দিকে বিশেষ নজর প্রদান করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। কোনো কোনো হাদিসে ব্যভিচারিণী ও নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যাকারীর কথাও বলা হয়েছে, যারা ক্ষমার অযোগ্য। অন্যদিকে হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবি করিম (স.) এই রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। তিনি আরো বলেন, নবি (স.) তাকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া-বকরির পশমের পরিমাণের চেয়েও অধিকসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ্-তায়ালা ক্ষমা করে দেন (তিরমিজি শরিফ: ৭৩৯)।
এতে বোঝা গেল, শবেবরাতের রাতে আল্লাহর নিকট মাগফিরাত কামনা করাটাই বড় আমল। এ জন্য এ রাতে আমাদের উচিত, বেশি বেশি নফল নামাজ আদায়, ইস্তিগফার, তাসবিহ-তাহলিল, কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, কবর জিয়ারত ইত্যাদির মাধ্যমে মহান আল্লাহর ক্ষমা লাভ ও অন্যের জন্য অনুরূপ দোয়া করার চেষ্টা করা। এজন্য নির্দিষ্ট সূরা বা নিয়ম-পদ্ধতিতে নামাজ আদায় কিংবা জিকির-আজকার প্রযোজ্য নয়। আবার শুধু বিশেষ রাতে নয়, আমাদের উচিত, বছরের প্রতিটি রাতের শেষাংশের বরকতময় সময়ে তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য উদ্গ্রীব হওয়া। এছাড়া শবেবরাতের সাথে ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক নাই।
এখানে উল্লেখ্য যে, শবেবরাতের ইবাদত ও আমল নিয়ে আমাদের সমাজে কিছু প্রচলিত ভুলবিভ্রান্তি রয়েছে। ইসলাম মধ্যপন্থাকে শ্রেয় মনে করে। এজন্য কোনো ব্যাপারে বাড়াবাড়ি কিংবা ছাড়াছাড়ির কোনো অবকাশ নেই। এ রাতে করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক; যেমন-রাত জেগে করতে গিয়ে যেন ফজরের নামাজ তরক না হয়। এছাড়া পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী—সবার জন্য বেশি বেশি দোয়া করা উত্তম। অন্যদিকে অগ্রহণযোগ্য ও বিদআতি কাজকর্ম থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন; যেমন-পটকা ফোটানো, তারাবাতি জ্বালানো, আতশবাজি করা ও আলোকসজ্জাসহ উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করা ইত্যাদি। এ ধরনের কাজ ইসলামের মূল আদর্শের পরিপন্থি। এ রাত্রি উপলক্ষ্যে হালুয়া-রুটিসহ বিশেষ খাবারদাবার রান্না করাও অপরিহার্য নয়। আবার এ উপলক্ষ্যে মসজিদে বা পাড়ায়-পাড়ায় হইচই বা শোরগোল করাও অনুচিত। দলবদ্ধভাবে কবর জিয়ারতের কথাও কোথাও বলা হয়নি। যেহেতু আজ পবিত্র শবেবরাতের পাশাপাশি পহেলা ফাল্গুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও পালন করা হবে, তাই এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদা সতর্ক থাকতে হবে। যাতে এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কেউ অশ্লীলতা বা উচ্ছৃঙ্খলতার পরিচয় দিতে না পারে।