মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি এক বক্তব্যে পরামর্শ দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত, গাজা ‘দখল করে নেওয়া’। এ ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের তিনি সরিয়ে নেওয়ার কথাও বলেছেন, যার সোজাসুজি অর্থ হলো ‘উচ্ছেদ করা’। শুধু তা-ই নয়, ফিলিস্তিনের এই উপত্যকাটিকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা’ বানানোর অভিলাষ পর্যন্ত ব্যক্ত করেছেন ট্রাম্প! ‘রিভিয়েরা’ মূলত উপকূলের এমন একটি এলাকা, যেখানে বিশেষ করে সৈকত আছে। ‘রিভিয়েরা’, তথা বিশেষ এই স্থানে মানুষ ছুটি কাটাতে যায়, যেমন—ফরাসি, ইতালীয় বা কর্নিশ রিভিয়েরা; অর্থাত্, ট্রাম্পের কথায় স্পষ্ট হয়, তিনি গাজাকে অবকাশযাপন কেন্দ্র করার কথা ভাবছেন! যদিও এটা করা খুব সহজ হবে না, অন্তত দুটি কারণে। প্রথমত, সবার কাছেই তা ‘অস্বস্তিকর’ মনে হবে এবং বিশেষ করে ফিলিস্তিনিরা এই ভূখণ্ড ‘অত্যন্ত ব্যক্তিগত’ বলে মনে করে। নিজ ভূখণ্ড সবার কাছেই ‘অত্যন্ত ব্যক্তিগত’, তথা আবেগের জায়গা। এই অর্থে, ট্রাম্পের ‘গাজা খালি করার হুংকার’ ফিলিস্তিনি বা গাজার বাসিন্দারা কতটা গায়ে মাখবেন, তা এক প্রশ্ন বটে।
গাজা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মন্তব্যগুলো ভালোভাবে নেননি আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরাও। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্পের এ আহ্বান বা পরামর্শ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে ২২ লাখ বাসিন্দাকে ‘জাতিগতভাবে নির্মূল’ করা আহ্বান ছাড়া আর কিছুই নয়! আর এ কারণে বিশ্লেষকরা স্বভাবতই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং সতর্কতা উচ্চারণ করে বলেছেন, ট্রাম্পের এ ধরনের কথা ইসরাইলের অতি-ডানপন্থি বসতি স্থাপনকারীদের উসকে দেবে। এতে করে আরো বড় যে ঘটনাটি ঘটবে, তা হলো—গাজা উপত্যকা বা পশ্চিম তীর থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে দিয়ে এই অঞ্চলের সমুদ্রতটে যারা ‘শুধু ইহুদি’ বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখে আসছে, তারা ইসরাইলের সরকারের প্রতি ঝুঁকবে, যাতে করে সুবিধা হবে নেতানিয়াহু সরকারের।
ট্রাম্পের মন্তব্যের পর জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের দূত রিয়াদ মনসুর বলেছেন, ‘আমাদের মাতৃভূমি আমাদেরই ভূমি’। তিনি যোগ করেন, ‘আমার মনে হয়, নেতা ও জনগণ উভয়ের উচিত, ফিলিস্তিনের জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানানো।’
আধুনিক ফিলিস্তিনের ইতিহাসের গবেষক হিসেবে আমি জানি, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দেওয়ার আহ্বান বা হুংকার কোনো নতুন ঘটনা নয়। পাশাপাশি এ কথাও মনে রাখতে হবে, ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকার দৃঢ়সংকল্পও নতুন নয়। এই দৃশ্য বিশ্ববাসী দেখে আসছে বিগত প্রায় ৮০ বছর ধরে। যখনই গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের প্রস্তাব ওঠে, তত্ক্ষণাত্ নিজেদের বিরোধী মনোভাবের জানান দেয় তারা। এতে করে বরং এক অর্থে তাদের ‘লাভ’ই হয়েছে! কারণ, গাজা নিয়ে বিভিন্ন সময় যখন ‘অভিলাষ পোষণ’ করার ঘটনা ঘটে, দখলদারিত্ব ও উচ্ছেদের মতো হুংকার আসে, তখন এসবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উত্সাহিত হওয়ার রসদ খুঁজে পায় এ উপত্যকাবাসী। বিগত ৮০ বছর ধরে যে চিত্র দেখে আসছে, তাতে করে তারা বেশ ভালোই জানে, কী করতে হবে। যদিও এবারের হিসাবটা একটু আলাদাই!
১৯৪৮ সালে ৭ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে পালিয়ে যায় কিংবা বিতাড়িত হতে বাধ্য হয়। ‘ইসরাইল রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজ বাসভূমে ক্রমশ ‘পরবাসী’ হয়ে পড়ে তারা! ঘটনা এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। নতুন দেশ ইসরাইলের সঙ্গে আরব প্রতিবেশীদের যুদ্ধ বেধে যায়। আর তার উত্তাপ ভোগ করতে হয় ফিলিস্তিনিদের।
ফিলিস্তিনিরা পরিণত হয় রাষ্ট্রহীন শরণার্থীতে। তাদের দেখভালের দায়িত্ব গিয়ে পড়ে জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থার ‘ইউএনআরডব্লিউএ’-এর ওপর। গাজা স্ট্রিপে এ সংস্থা আটটি শরণার্থীশিবির স্থাপন করে ১৯০টিরও বেশি শহর ও গ্রাম থেকে বিতাড়িত ২ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে দেখভাল করতে থাকে।
এরপর ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৪ নাম্বার প্রস্তাব গ্রহণ করে; যাতে বলা হয়, ‘যেসব শরণার্থী তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে চায় এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চায়, তাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তা করার অনুমতি দেওয়া উচিত।’ ইসরাইলের নেতারা প্রথম দিকে এতে রাজিও হয়। ফলে কিছু শরণার্থীর ফিরে আসার রাস্তা তৈরি হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। কারণ, শরণার্থীদের সম্পূর্ণভাবে ফিরে আসার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বসে তেলআবিব। তাদের যুক্তি ছিল, এমনটা করা হলে ইসরাইলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে এবং ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে ইসরাইলের চরিত্র ক্ষুণ্ন হবে।
ঠিক এমন একটি পটভূমিতে ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন জর্ডানের দিকে শরণার্থীদের ঠেলে দিতে চেষ্টা চালান। খুঁজতে থাকেন ভুক্তভোগী শরণার্থীদের ‘পূর্ব দিকে স্থানান্তরিত করতে উদ্বুদ্ধ’ করার উপায়। সম্ভবত তিনি আশা করেছিলেন, শরণার্থীদের ইসরাইল থেকে আরো দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলে তাদের ফিরে আসার রাস্তা চিরদিনের মতো বন্ধ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, তার সেই আশা কেবল আশাই রয়ে গেছে!
এ নিয়ে নানা ‘খেলা’ চলেছে বিশ্বরাজনীতিতে! প্রথমদিকে, ইসরাইলকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শরণার্থী ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে ইসরাইল ধারাবাহিকভাবে তা অস্বীকার করতে থাকে। ফলে ওয়াশিংটনের নেতারা ‘পুনর্বাসনের ধারণা’র দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন। তারা আশা করেছিলেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে অন্যান্য আরব দেশে স্থানান্তরিত করা যাবে; এতে করে তারা প্রলুব্ধ হবে এবং নিজ ভূমিতে ফেরার আশা ছেড়ে দেবে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫৩ সালে পররাষ্ট্রসচিব জন ফস্টার ডালেস সিরিয়ায় একটি বড় জল ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন।
একইভাবে, ১৯৬১ সালে নব-গঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, তথা ইউএসএআইড জর্ডানে একটি সেচ প্রকল্পে অর্থায়ন শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল, সেখানে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের কৃষক হিসেবে কাজে নিয়োগ করা। মার্কিন কর্মকর্তাদের আশা ছিল, শরণার্থীরা নিজেদের ‘ফিলিস্তিনি’ ভাবার পরিবর্তে ‘জর্ডানীয়’ হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করবে এবং একপর্যায়ে জর্ডানে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনে সম্মত হবে।
মজার বিষয় হলো, এই পরিকল্পনাও কাজ করেনি। বছর পাঁচেক পর করা এক জরিপে দেখা যায়, শরণার্থীরা এখনো নিজেদের ‘ফিলিস্তিনি’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে এবং নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চাইছে। এভাবে যখনই ফিলিস্তিনিদের পুনর্বাসন করার ‘পরিকল্পনা’ করা হয়, তা যে তারা প্রত্যাখ্যান করবে, তা ধরে নিয়েই হিসাবনিকাশ চলে। অর্থাৎ, বিষয়টা বেশ জটিল!
১৯৬৭ সালের ঘটনা। এ বছর ইসরাইলের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর যুদ্ধ লেগে যায়। একপর্যায়ে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম চলে যায় ইসরাইলের দখলে। পূর্বে এই অঞ্চল জর্ডানের শাসনাধীনে ছিল। তবে ঘটনা যেটা ঘটে, ঐ সময় গাজা স্ট্রিপও দখল করে নেয় তেলআবিব, যার শাসনভার ছিল মিশরের হাতে।
যাহোক, সময়ের পথপরিক্রমা এবং নানা ঘাতপ্রতিঘাতে ফিলিস্তিনিদের মাথার ভেতর একটি বিষয় খুব করে ঢুকে যায়; আর তা হলো ‘মাতৃভূমি’। ফিলিস্তিনি জাতীয় পরিচয়ের এক নতুন অনুভূতি জেগে ওঠে তাদের মধ্যে। বিশেষ করে, ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে তরুণ প্রজন্ম। ইসরাইল ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের ফেরার অধিকার স্বীকার করে নিতে বাধ্য করার জন্য ‘গেরিলা কৌশল অবলম্বন’ করতে শুরু করে তারা।
এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে আবারও সেই একই পথে হাঁটে ইসরাইল। ‘পুনর্বাসন’কেই তারা কার্যকর উপায় হিসেবে দেখে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে গাজা থেকে ৬০ হাজার ফিলিস্তিনিকে স্থায়ীভাবে প্যারাগুয়েতে স্থানান্তর করার গোপন পরিকল্পনা তৈরি করে ইসরাইলি সরকার। তবে সেই পরিকল্পনাও হঠাত্ করে বন্ধ হয়ে যায়, যখন দুই ফিলিস্তিনি নাগরিক আসুনসিওনে ইসরাইলি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করে এবং মিথ্যা অজুহাতে তাদের প্যারাগুয়েতে আনার বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। এই অর্থে বলা যায়, ফিলিস্তিনি নাগরিকদের পুনর্বাসন উদ্যোগ খুব একটা কাজে আসবে বলে মনে হয় না।
আমার বিশ্বাস, ফিলিস্তিনিরা পুনর্বাসন নয়, বরং পুনর্নির্মাণে সাহায্য চায়। তাদের অনেকেই ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের গাজা ছেড়ে যাওয়ার আহ্বানকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন; যেমন—দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় সাক্ষাত্কালে এক ফিলিস্তিনি বলেছেন, ‘আমরা এ ভূমি ছেড়ে যাওয়ার চেয়ে বরং এখানেই মরতে রাজি আছি।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘কোনো পরিমাণ অর্থই মাতৃভূমির কোনো বিনিময় হতে পারে না।’
লেখক : অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকান স্টাডিজ স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক
দ্য কনভারসেশন থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন