মানবাধিকার এমন এক সর্বজনীন নীতি, যা প্রতিটি মানুষের জন্য তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, বা আর্থসামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে কোনো প্রকার বৈষম্য এই অধিকার সীমিত করতে পারে না। এই ধারণাগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে, যেখানে ৩০টি ধারা প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। মানবাধিকার মূলত কতকগুলো সংবিধিবদ্ধ আইন বা নিয়মের সমষ্টি। বিশ্ব মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর পালিত হয় মানবাধিকার দিবস।
মানবাধিকার মানুষের সম্মান, স্বাধীনতা ও জীবনের ভিত্তি। এর মধ্যে জীবনের অধিকার, বাকস্বাধীনতা, ধর্মচর্চার স্বাধীনতা, শিক্ষার সুযোগ, এবং ন্যায়বিচারের অধিকার অন্তর্ভুক্ত। মানবাধিকার শুধু ব্যক্তি নয়, বরং একটি সমাজ ও রাষ্ট্রেরও প্রগতির মাপকাঠি। যখন সমাজে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তখন সামাজিক বৈষম্য, সহিংসতা ও সংকট বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে, এই অধিকার নিশ্চিত হলে শান্তি, ন্যায়বিচার ও সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এর চর্চা এবং বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। গাজা, সিরিয়া, ইয়েমেন ও সুদানের মতো দেশগুলোতে চলমান যুদ্ধ এবং সংঘাত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ উদাহরণ। এসব যুদ্ধে নারী, শিশু এবং নিরপরাধ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। ফিলিস্তিনে প্রতিনিয়ত ক্ষুণ্ন হচ্ছে মানবাধিকার। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এক্ষত্রে বিশ্ব মানবতা পালন করছে নীরব ভূমিকা।
অনেক দেশে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। বিরোধী মত দমন করতে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেফতার, নির্যাতন এবং হত্যার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এছাড়া সংঘাত-সংকুল অঞ্চলগুলোতে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে লাখ লাখ মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্যের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে এমন বহু জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে।
বিশ্বের অনান্য দেশের মত বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রগতির পাশাপাশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। নারী নির্যাতন, যৌতুক, এবং শিশুশ্রম এখনো বড় সমস্যা দেশের জন্য। প্রতিদিন পারিবারিক সহিংসতা ও বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে অনেকে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত হওয়ার অভিযোগও শোনা যায় নিয়মিত বিরতিতে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো বিতর্কগুলোও পিছু ছাড়ে না।
গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষায় উন্নতি হলেও এখনো নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা যায়নি। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে বহু নারীশ্রমিক নিয়োজিত আছেন। তাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করতে হবে।
মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এমন আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যা মানবাধিকারের সুরক্ষায় রাখবে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানব মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখতে মানবাধিকার নিশ্চিত করা কোনো বিকল্প নেই। আর এর জন্য শুধু রাষ্ট্র নয়, প্রতিটি নাগরিক, সমাজ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা রয়েছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই আমরা একটি ন্যায্য, সমৃদ্ধ ও মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার অধিকারের মর্যাদা উপভোগের সুযোগ পাবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ