মামানুষের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার সাথে শিম্পাঞ্জির বেশ কিছু আচরণের মিল রয়েছে। শিম্পাজি নেতারা রীতিমতো রাজনীতি করে সমাজে নিজের প্রভুত্ব কায়েম করে রাখে! ‘তুখোড় পলিটিশিয়ান’ শিম্পাঞ্জি নেতারা লুটপাট করে এবং তা নিজ দলের নেতাকর্মীর মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে থাকে। শিম্পাঞ্জি নেতারা মনে করে—‘হিটলারি ইমেজ’ ভালো, কিন্তু তার চাইতে ভাল সকলের মন জয় করে চলা। অনেক সময় শিম্পাঞ্জিদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতারা শুধু শক্তি প্রদর্শন করে, দমন পীড়নের নীতি চালিয়ে পরিস্থিতিকে বাগে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু একটি সময়ে এসে দেখা যায়, এর ফলে সেই সকল শিম্পাঞ্জি নেতা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। পক্ষান্তরে, সেই সকল শিম্পাঞ্জি দলনেতার রাজনীতি টিকে থাকে, যারা শক্তিমত্তা প্রদর্শনের পাশাপাশি নমনীয়তা ও সহিষ্ণুতাও দেখায়। ফলে তারা নির্বি দাদাগিরি চালিয়ে যেতে পারে রাজনীতিতে।
টিকে থাকার স্বার্থে কিংবা ক্ষমতার মসনদে পৌঁছাতে শিম্পাজিদের মানুষের মতো এভাবে রাজনীতি করার চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক জেমস টিলের এক গবেষণায়। এই সকল সংস্কৃতি শিম্পাজি ও মনুষ্যজাতি কে কাহার কাছ থেকে রপ্ত করেছে, তা জানা যায়নি। তবে গবেষণায় একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার যে, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রেই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জর্জরিত। হিংসা-প্রতিহিংসা রাজনীতির সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ পলিটিক্সের প্রথম পাঠ হলো— রাজনীতিতে প্রতিহিংসার কোনো স্থান নেই। রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে, তথাপি সেখানে কোনোক্রমেই প্রতিহিংসা থাকতে পারে না।
মজার ব্যাপার হলো, শিম্পাঞ্জিদের রাজনীতিতে নেতাদের চরিত্র হননের সংস্কৃতি নেই, যা মানুষের রাজনীতিতে আছে। বিশেষত উন্নয়নশীল বিশে^ ক্ষমতার পালাবদল পরবর্তী সময়ে এটা অতি প্রকট হয়ে ওঠে। বিরোধী নেতাদের হেয় করতে হেন চেষ্টা নেই, যা করা হয় না। কথায় কথায় নেতারা একে অন্যকে থাপড়িয়ে দাঁত ফেলিয়ে দেওয়া, চামড়া তুলে নেওয়া, দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার হুংকার দেন! ভিন্ন দল ও মতের নেতা বা কর্মীদের মূলোৎপাটন, উৎখাত ও নির্মূল করা— নেতাদের মুখ থেকে কেবল এ সকল শব্দই ঘুরেফিরে শুনতে পাওয়া যায়। অথচ তারা ভুলে যায় যে, এর ফলে গোটা রাজনৈতিক অঙ্গনেই একধরনের অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে, জনগণের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের দুরত্ব বেড়ে যেতে পারে। সর্বোপরি, রাজনৈতিক পরিবেশ হয়ে উঠতে পারে অস্থির, অস্থিতিশীল। মূলত এ কারণেই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দেখা যায়, যিনি বা যারাই ক্ষমতায় আসেন, তারা পড়ে যান গোলকধাঁধায়! কারণ, এ সকল দেশে সরকার পরিচালনায় এন্ট্রি এবং এক্সিট নেওয়ার পথ বেশ অমসৃণ! এখানে সরকারে ‘যাওয়া-আসার পথ’ কখনোই নিষ্কন্টক নয়। ফলে উন্নত বিশ্বে আমরা যেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তর হতে দেখি, সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার ঠাঁওর করতে থাকে, ‘কীভাবে এখানে ঢুকলাম এবং কীভাবেই-বা বের হব?’
পাঁচ দশকের বেশি হলো আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি, কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি জনগণের কতটা প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে, তা ভেবে দেখার বিষয়। বরং বলতে হয়, রাজনীতিতে আমাদের সবচাইতে বড় অর্জন হলো ‘প্রতিহিংসাপরায়ণতা’। যখন যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব চালকের আসনে থাকে, প্রায় সকলেই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে। এ অবস্থায় বিরোধী দলগুলোর রাজনীতি করার গ্রাউন্ড থাকেনা। হামলা-মামলা মাথায় নিয়ে তারা মাঠের বাইরে পড়ে যায়। ফলে এই অপসংস্কৃতির কারণে রাজনীতির মহত্ব বিনষ্ট হয়, হুমকিধমকির মুখে রাজনীতির সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং রাজনীতি হতে ভালো মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে যেতে থাকে। এই পরিস্থিতির উত্তরণ হবে কীভাবে, তা এক কঠিন প্রশ্ন বটে।
উন্নত দেশগুলোতে আমরা লক্ষ করে থাকি, সেখানে অন্যের মতের সঙ্গে নিজের মত না মিললে কিংবা তিনি ভুল কিছু বললেও সৌজন্যতার খাতিরে হলেও তারা ‘মে বি ইউ আর রাইট’— এই ধরনের কথা বলে থাকেন। পরমতসহিষ্ণুতার এই অভ্যাস উন্নয়নশীল বিশ্বের নেতারা আত্মস্থ করতে পারলে তা হবে এই জাতির জন্য রাজনীতিতে একটি বড় অর্জন। ‘মে বি ইউ আর রাইট’— এই ছোট্ট বাক্যটির প্রচলনই একটি দেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।