এক সময়কার ইতিহাস আর ঐতিহ্যের শহর ঢাকা আজ যেন তার চিরচেনা সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। আধুনিক শহরায়নের এই যুগে ঢাকার রাস্তাঘাট, ভবনের দেওয়াল এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে পোস্টার আর বিজ্ঞাপনের অগণিত কাগজ। ফ্ল্যাট বিক্রি, প্রাইভেট পড়ানোর বিজ্ঞাপন, রাজনৈতিক প্রচারণা, এমনকি সামাজিক অনুষ্ঠানের পোস্টার—সব মিলিয়ে শহরের সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে। পোস্টার লাগানোর এই কাজ কেবল শহরের সৌন্দর্যকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না; বরং আমাদের মানসিক ও পরিবেশের ওপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
দেওয়ালে পোস্টার লাগানোর অন্যতম প্রধান কারণ হলো সহজলভ্য বিজ্ঞাপন মাধ্যম। ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে করপোরেট, এমনকি রাজনৈতিক প্রচারণার ক্ষেত্রেও এটি জনপ্রিয় মাধ্যম। কিন্তু এর ফলে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। দেওয়ালে লাগানো পোস্টারগুলো ময়লা, ধুলা ও আবর্জনার আবরণ তৈরি করে, যা শহরের পরিচ্ছন্নতাকে নষ্ট করে, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ক্ষতি করে। পুরোনো স্থাপনাগুলোতে পোস্টার লাগানোর ফলে তাদের রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন হয়ে পড়ছে।
আমাদের পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। পোস্টার ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে গেলে সেগুলো থেকে পরিবেশ দূষণ হয়। কারণ রঙিন কাগজে ব্যবহূত রাসায়নিক পদার্থ মাটির জন্য অনেক ক্ষতিকর। এছাড়া দেওয়ালের পোস্টার লাগানো মানসিক বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেওয়ালে এলোমেলো পোস্টার মানুষের চোখে বিরক্তিকর লাগে, যা শহরের বাসিন্দাদের মানসিক প্রশান্তি কমিয়ে দেয়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন আইনে দেওয়ালে পোস্টার লাগানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে, সঠিক নজরদারির অভাবে এই আইন কার্যকর হয় না। বরং রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠনগুলোও এই সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। তাই শহরের দেওয়ালগুলোকে পোস্টারমুক্ত করতে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে এবং প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। বিজ্ঞাপন বা প্রচারণার জন্য ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করতে হবে।
ফেসবুক, ইউটিউব, কিংবা ডিজিটাল বিলবোর্ড হতে পারে পোস্টারের বিকল্প। শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্দিষ্ট বিজ্ঞাপন বোর্ড স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে সবাই পোস্টার লাগাতে পারবে। স্কুল, কলেজ ও অফিসগুলোতে সচেতনতা কর্মসূচি চালু করে মানুষকে বোঝানো যেতে পারে দেওয়ালে পোস্টার লাগানোর ক্ষতিকর দিকগুলো।
যারা দেওয়ালে পোস্টার লাগাবে, তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা বা শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে দেওয়াল পরিষ্কার রাখার জন্য নিয়মিত উদ্যোগ নিতে হবে। একটি শহর তার স্থাপত্য, সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি পায়। ঢাকার মতো শহরের দেওয়ালগুলো আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক। এগুলো নষ্ট করা মানে কেবল শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করা নয়, বরং এগুলো আমাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়। তাই আমাদের শহরকে আমাদেরই সাজাতে হবে। এটি পরিচ্ছন্ন রাখা এবং এর ঐতিহ্য রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আসুন, আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে, আমরা দেওয়ালে পোস্টার লাগাব না এবং অন্যদেরও এই বিষয়ে সচেতন করব। পরিচ্ছন্ন, সুন্দর ও পোস্টারমুক্ত নগর গড়ে উঠুক আমাদের হাত ধরেই।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ