মানুষ ধনী হতে চায়, এটা চিরন্তন সত্য। আর্থিক সচ্ছলতা এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের জন্য মানুষ দিন-রাত পরিশ্রম করে ধন-সম্পদ সঞ্চয় করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন মানুষের ভালোভাবে জীবনযাপনের জন্য প্রকৃতপক্ষে ঠিক কতটুকু ধনসম্পদ প্রয়োজন? মানুষের এ তীব্র ধনী হওয়ার বাসনার অন্তর্নিহিত কারণ কী? আধুনিক মনোবিজ্ঞানের জনক আব্রাহাম মাসলো তার ‘প্রয়োজনের ক্রমসোপান’ তত্ত্বে বলেছেন, মানুষের প্রয়োজন স্তরভেদে পরিবর্তিত হয়। প্রথমে মৌলিক প্রয়োজন যেমন খাদ্য, পানি, আশ্রয় পূরণ করা আবশ্যক। তারপর নিরাপত্তার চাহিদা এবং সামাজিক স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা সামনে এসে দাঁড়ায়। এই স্তর অতিক্রম করলে মানুষ আত্মবিকাশের দিকে মনোনিবেশ করে। ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রায়শই নিরাপত্তা ও সামাজিক স্বীকৃতি লাভের একপ্রকার মাধ্যমরূপে কাজ করে। অ্যারিস্টটল, প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক, মানবজীবনের উদ্দেশ্য বিষয়ে বলেছেন, ‘ইউডাইমনিয়া’ বা সুখ ও পূর্ণতা হলো মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য। তিনি উল্লেখ করেছেন, ধন-সম্পদ সুখের চূড়ান্ত মাধ্যম নয়; বরং এটা মানুষের সঠিক কাজ এবং নৈতিক গুণাবলির সহায়ক। অতএব, ধন কেবল একটি উপকরণ, কিন্তু লক্ষ্য নয়। গৌতম বুদ্ধ তার দর্শনে আকাঙ্ক্ষা বা তৃষ্ণাকেই দুঃখের মূল কারণ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি মধ্যপথ অনুসরণের উপদেশ দিয়েছেন, যেখানে চাহিদা সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত।
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, ভালোভাবে জীবনযাপনের জন্য মানুষের প্রকৃতপক্ষে কতটুকু প্রয়োজন? মানুষের প্রয়োজন মৌলিক চাহিদা পূরণ, নিরাপদ আশ্রয়, সামাজিক সম্পর্ক এবং মানসিক শান্তি। এর অধিকাংশ চাহিদা পূরণ হলে অতিরিক্ত ধন-সম্পদ বিলাসিতার উপকরণে পরিণত হয়। এজন্য মনীষীরা বলে থাকেন—পৃথিবীতে সকলের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে, কিন্তু লোভ মেটানোর জন্য নয়। দুঃখজনকভাবে, উন্নয়নশীল বিশ্বের সমাজে একশ্রেণির মানুষ ধনী হওয়ার জন্য উন্মত্ত হয়ে পড়েন। এর জন্য তারা যে কোনো নীতি ও ন্যায়বোধ বিসর্জন দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না। ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনেক সময় নিরাপত্তা ও স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমরূপে কাজ করে। ধন-সম্পদ প্রায়শই অতৃপ্ত লোভের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এসব কারণে উন্নয়নশীল দেশসমূহে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেদের বিত্তশালী করতে চান! এতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনমানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিহাসের কথা হলো, দুর্নীতির মাধ্যমে ধনী হওয়া মানুষগুলোকে শেষপর্যন্ত জীবনের কোনো এক সময়ে এসে এর ভয়াবহ পরিণতি ঠিকই ভোগ করতে হয়। আর এর ফলে তারা তাদের অসৎ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদ এবং মান-সম্মান উভয়ই হারান।
সুতরাং, এদের আমরা ধনী বলব কী করে? আমরা স্মরণ করতে পারি দার্শনিক লাও জুর ব্যঞ্জনাময় ভাবনাটি। ‘ধনী কে?’—এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘ধনী তিনি-ই, যার লোভ কম।’ লাও জু বর্ণিত দর্শন অনুযায়ী, পৃথিবীতে ধনী খুঁজতে আতশ কাচ লাগবে। আবার অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন—পুঁজিবাদ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সম্পদ সৃষ্টিসহ অনেক ক্ষেত্রে ‘লোভ’ই হলো ড্রাইভিং ফোর্স তথা চালিকাশক্তি। তবে লোভ আর মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের চাহিদা এক নয়। মানুষ যদি তার চাহিদা ও লোভের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে সক্ষম না হয়, তাহলে সে বা তিনি সুখ ও শান্তিময় জীবনযাপন নিশ্চিত করতে পারবেন না। সত্যিকারের সমৃদ্ধি তা-ই, যার সামান্য কিছু দিয়েই ভালোভাবে জীবনযাপন করা যায়। এই ভাবনা খুব কম মানুষের মধ্যে রয়েছে। একমাত্র নৈতিকতা, পরিমিতিবোধ এবং মানবিক গুণাবলির চর্চার মাধ্যমেই জীবনের প্রকৃত সুখ অর্জিত হতে পারে। এতে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের কল্যাণ নিহিত। শেষাবধি আমাদের প্রত্যেকের লাগবে তো মাত্র ‘সাড়ে তিন হাত জমি’। বস্তুত, বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনো দুর্নীতির ফাঁদে পা দিতে পারেন না। কারণ, শেষ পর্যন্ত তাতে ইহকাল ও পরকাল—উভয়কালই নষ্ট হয়।