আমাদের শিক্ষা দানের উদ্দেশ্য কী, তা ঠিক করে নেওয়া দরকার। আর তাই প্রশ্ন ওঠে— এই বিরাট যাত্রার পথশেষ কোথায়? এই পথনির্দেশ সম্বন্ধে কতই না দেশে দেশে লেখা হয়েছে, বলা হয়েছে। কারো মতে আমাদের মনোবৃত্তিগুলোর সম্যক বিকাশ সাধনই শিক্ষার উদ্দেশ্য, কারো মতে ব্যক্তিত্বের উন্মেষ সাধনই শিক্ষার কাম্য, আবার কারো মতে চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই আমাদের প্রধান কর্তব্য। কিন্তু এ সকল উদ্দেশের ভেতরেই একটা মস্ত বড় ফাঁক থেকে গেছে! ব্যক্তিত্বের উন্মেষ সাধন বা মনোবৃত্তিগুলোর সম্যক বিকাশ সাধন দরকার। তবে এ কথা পাশ্চাত্যের পণ্ডিতেরা স্পষ্ট করে কোনো দিন বলেননি। কারণ, তাঁরা এ বিষয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি।
শিক্ষা মানুষকে শিখিয়ে দেয় তার পিতৃঋণ শোধ করতে, তার দেবঋণ শোধ করতে, তার সমাজঋণ শোধ করতে, তার রাষ্ট্রঋণ শোধ করতে। আজ এই শিক্ষা শুধু পাশ্চাত্যেই কেন, সমগ্র বিশ্বের কাছে কাম্য হয়ে উঠেছে। কারণ, জগৎ বুঝতে পেরেছে— ব্যক্তিত্বের নেশার ঝোঁকে আমরা মেতে উঠি শুধু আমাদের অধিকারের দাবীদাওয়াগুলো নিয়ে, ভুলে যাই প্রতি অধিকারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে গাঁথা আছে আমাদের কর্তব্য— পিতামাতার প্রতি, শিক্ষকের প্রতি, দেশের চিরন্তন আদর্শগুলির প্রতি, সমাজের প্রতি, নিজের প্রতি।
একথা সত্যি, সকল শিক্ষকই সমান হন না। সকলেই রাগবির ডাঃ আর্ণল্ডের (Dr. Arnold) মত বা কেম্ব্রিজের লর্ড অ্যাক্টনের মত উচুদরের শিক্ষক হতে পারেন না। শিক্ষকের সুশিক্ষকতা নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের উপর— তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি, পরিশ্রমশীলতা, সহিষ্ণুতা, বাগ্মিতা, শিক্ষাপ্রণালী, কার্যকৌশল, স্বাস্থ্য, শিক্ষাদানে তাঁর আন্তরিকতা। সকলের সমান জ্ঞানবুদ্ধি, কার্যকৌশল বা পরিশ্রম করবার ক্ষমতা থাকে না। সেজন্যে শিক্ষকে শিক্ষকের কিছু প্রভেদ থাকবেই। কিন্তু শিক্ষাদানে আন্তরিকতা ও যে উদ্দেশ্য নিয়ে ব্রতী হয়েছেন তাতে একটা অটল বিশ্বাস না থাকলে এর চাইতে লজ্জা ও পাপের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না।
যতই অপ্রিয় হোক, একথা সত্যি যে আজ দেশে যে প্রকৃত শিক্ষার এত অধোগতি হয়েছে সেজন্য আমরা শিক্ষকেরাই অনেকাংশে দায়ী। শিক্ষাদানে আজ আমাদের বেশীর ভাগ লোকের ভেতর আন্তরিকতা আছে বললে সত্যের অপলাপ করা হবে, বস্তুতঃ শিক্ষাদানে আমাদের মন নেই। শিক্ষাদানের কোন উদ্দেশ্য আছে কিনা সে বিষয়েও আমরা কোন চিন্তা করি না। কাজেই কোন উচু আদর্শের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হবার কথাও ওঠে না।
যদি ধরেই নেওয়া যায় যে এদেশ শিক্ষকের বেতন অন্যান্য চাকুরির তুলনায় চিরদিনই কম, তবুও এ কথা আমাদের বলবার অধিকার নেই যে মাইনে কম, আমরা ভাল করে পড়াব না, ছেলেদের তত্ত্বাবধান করব না, বিকেল বেলা তাদের দেখাশুনো করব না, তাদের বাড়ী গিয়ে খোঁজ খবর করব না।
আমি এ একান্ত বিশ্বাস করি শিক্ষাদানকার্য যদি সুন্দররূপে সম্পন্ন হয়, শিক্ষার্থী যদি তার সমস্ত প্রাণ দিয়ে এইটুকু উপলব্ধি করতে পারে, আমাদের শিক্ষকেরা সর্বান্তঃকরণে আমাদের স্নেহ করেন ও আমাদের মঙ্গলের জন্য সতত সচেষ্ট, তা হলে কড়া শাসনের কোন প্রয়োজনই হয় না, কিন্তু দুঃখের বিষয় বাস্তবের ছবি একেবারেই বিভিন্ন।
আমরা শিক্ষক, আমাদের স্থান সত্যি জগতের শীর্ষে— নিঃস্বার্থভাবে এক একটী অসহায় অসুন্দর জীবনকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে গড়ে তোলার যে আনন্দ, গৌরব, সম্মান ও আত্মতৃপ্তি তা আমাদেরই। সে সুখ থেকে বঞ্চিত করছি আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে, অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ অপ্রিয় সত্য বলতে সাহস পেলাম আজ এই জন্যে যে বিবেকবানরা একবার চিন্তা করে দেখবেন।
উগ্র জাতীয়তাবাদের বর্বরতা আমাদের একথা শিখিয়েছে যে কোন জাতি যদি তার অতীত ইতিহাস নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তবে তা সামাজিক ব্যাধি অথবা অন্যায় হিসাবে গণ্য হবে। কমিউনিস্টরা তাদের সাথে বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিত। স্তালিনের মৃত্যুর পরে কমিউনিস্ট দেশগুলিতে যে সব গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে সে গুলোও ছিল অপ্রত্যাশিত। তারপরও হয়েছে। শেখ হাসিনার পতন হলেও আমরা শৃক্সক্ষলায় ফিরে আসতে পারছিনা, এ কথা সত্য। শিক্ষার পদ্ধতি গেছে পালটে। এক সময় একজন রাজপুত্রও ঋষিমুনিদের সেবায় নিয়োজিত করতেন বিদ্যা লাভের উদ্দেশ্যে। গুরু সেবা করেই শিষ্যের প্রকৃত শিক্ষা লাভ হয়। ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ রাজা দশরথকে বলেছিলেন যে, আপনি রাম-লক্ষণকে ঋষিমুনিদের সেবায় নিয়োজিত করুন। এই সেবার পথেই তারা জ্ঞানবান হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন আজ কেউ তার সন্তানকে শিক্ষকের সেবায় নিযুক্ত করে না। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক হয়ে উচ্চশিক্ষা সকল স্তরে পড়তে আসা সবাই বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। নিয়মমাফিক শিক্ষক মশাইরা ক্লাসে যান তাদের লেকচার দেন, ক্লাশ শেষে তাঁরা বাড়ি ফিরে যান। ক্লাশের বাইরে কিংবা ভিতরে কোন সংস্পর্শ তৈরি হয় না।
আজ শিক্ষার্থীরাই শিক্ষক তথা জাতির অভিভাবক। আজ মিথ্যা হতে চলেছে We obey our parents. উপরন্তু এখন বলতে হবে We obey our student or child. এর দায় শিক্ষক হিসাবে মাথা পেতে নিতে আপত্তি নেই।
লেখক: কলেজ শিক্ষক ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য