‘সবচেয়ে খেতে ভালো মানুষের রক্ত’—কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই কথার বাস্তব চিত্র সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমগ্র বিশ্বেই স্পষ্ট। ফুলকলিসম শিশুদের শৈশব নিংড়ে নিংড়ে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ প্রাচুর্যের পাহাড় গড়েছে, অথচ শৈশব সময়টা হচ্ছে একজন মানুষের জীবন গঠনের প্রারম্ভ মুহূর্ত। সুকুমার বিকাশ, মেধা ও প্রতিভার খেঁাজ মানুষ এ বয়সেই পেয়ে থাকে। অথচ আমাদের এই দেশে দিন দিন শিশুর মেধা বিকাশের সে পথটিকে করা হচ্ছে রুদ্ধ। যদি আমরা পিছনে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, শিশুদের শ্রমবৃত্তিতে নিয়োগ প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে।
বিভিন্ন দেশে আর্থসামাজিক অবস্থার ভিন্নতা, সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধের ভিন্নতা, প্রকৃতি ও পরিবেশের ভিন্নতার কারণে দেশে দেশে শিশুর বয়স নির্ধারণে কিছুটা পার্থক্য আছে। আবার একই দেশে কাজের ধরন ও কাজের পরিবেশের কারণে শিশুর বয়স নির্ধারণে পার্থক্য হয়। যেমন জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (১৯৮৯) অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সব মানবসন্তানকে শিশু বলা হবে, যদি না শিশুর জন্য প্রযোজ্য আইনের আওতায় ১৮ বছরের আগেও শিশুকে সাবালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুযায়ী ১৫ বছরের নিচে মানবসন্তানকে শিশু বলা হবে, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ১৮ বছরের নিচের বয়সের মানবসন্তানকে শিশু বলতে হবে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী যাদের বয়স ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি তাদের শিশু বলা হয়। প্রচলিত আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত বয়সের চেয়ে কম বয়সে কাজে নিয়োজিত সকল শ্রমিকই শিশুশ্রমিক। বিশেষজ্ঞদের ঐকমত্য অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সকল ক্ষেত্রে শিশুর জন্য শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক দিক থেকে ক্ষতিকর এবং শিশুর প্রয়োজন ও অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বঞ্চনামূলক শ্রমই শিশুশ্রম।
বর্তমানে যারা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করে এবং পৃথিবীতে আর্দশের ঝান্ডা উড়ানোয় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তারাও শিশুদের শৈশব নিয়ে অর্থের লোভে ছিনিমিনি খেলে। সারা দিন ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা পরিশ্রম করে শিশুরা যে পারিশ্রমিক লাভ করে, তা দিয়ে সামান্য খাবারও জোটানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। উপরন্তু পরিশ্রমের সঙ্গে যোগ হয় নানারূপ শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনা। পত্রিকার পাতায় দেখা যায় শিশুদের ওপর বিভিন্ন অমানবিক নির্যাতন, অপরাধসহ মৃত্যুর ঘটনা। ফলে শ্রমজীবী শিশুদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। পোশাকশিল্প, চামড়াশিল্প, নির্মাণশিল্প, হোটেল-রেস্তোরাঁ, যানবাহন ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেখতে পাই কীভাবে শিশু শ্রম বিক্রি করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা—যাওয়ার পথে দেখতাম ৮ থেকে ১২ বছরের শিশুরা যানবাহনের হেলপার, খবরের কাগজ, ফুল, আচার, ঝালমুড়ি বিক্রি এমনকি ভিক্ষাবৃত্তি করতে। আমার কষ্টগুলো চেপে রাখতাম।মূলত দারিদ্র্যের কারণে বাবা—মায়েরা তাদের শিশুদের শ্রমে নিয়োজিত করেন। আর এই সুযোগে পুঁজিপতি ধনিক শ্রেণি এদের শ্রমকে সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ক্রয় করে। তাদেরকে দিয়ে বিভিন্ন অপরাধ করাতে দ্বিধাবোধ করে না। শেষ পর্যন্ত নেশার জগৎ থেকে শুরু করে ইভটিজিং, মাদক গ্রহণসহ নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
যখন শৈশবকালে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শিশুরা কঠিন শ্রমে জড়িয়ে পড়ে তখন তাদের বুদ্ধির স্বাভাবিক বিকাশ হয় না। শিক্ষার আলো বিবর্জিত পরিবেশে এরা অশিক্ষিত, গোঁড়া ও দুশ্চরিত্র হিসাবে বেড়ে ওঠে। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় সন্ত্রাস, চুরি—ডাকাতি মতো ঘটনার এবং অশিক্ষিত এ সমস্ত মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও শিক্ষার দিকে ধাবিত করে না। অকালে ঝরে পড়ে অনেকগুলো সম্ভাবনাÑমেধাবী ফুলকুঁড়ি। তাই আমাদের সমাজ ও জাতিকে আলোকিত করতে হলে এবং স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে শিশুশ্রম বন্ধ করে তাদের শিক্ষার ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজের দরিদ্র শ্রেণির জন্য অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করাসহ এ ব্যাপারে বিভিন্ন নীতিমালা বাস্তবায়নে নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। পাশাপাশি শিশুরা যেন শ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে এবং তাদের প্রলোভন দেখিয়ে কেউ যেন কোনো অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত করতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ কিংবা আইন প্রণয়ন করতে হবে।
আজকের শিশুরাই আগামী জাতির ভবিষ্যৎ। সুতরাং ভবিষ্যৎকে আলোকিত করতে চাইলে অভিভাবক, সমাজ ও সরকারকে সহানুভূতির হাত বাড়াতে হবে এবং শিশুশ্রম বন্ধের মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে শৈশবের আনন্দময় আলোকিত আঙিনা।
লেখক : সাউথ এশিয়ান কলেজের (চট্টগ্রাম) প্রভাষক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের উপদেষ্টা ও সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী।