গতকাল (১২ জানুয়ারি) আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, দেশের আইন—শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হছেছেÑএমন কথা তিনি বিশ্বাস করেন না। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হলে তো আমরা এখানে ঢুকতে পারতাম না।’ অবশ্য ‘মাঝে মধ্যে দুয়েকটি ঘটনা ঘটছে’ উল্লেখ করে ‘সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন’ নেওয়া হচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ব্যক্ত করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
তবে বাস্তবতা হলো, গত ৫ আগষ্ট রাজনৈতিক পটপরবির্তনের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক ও শোচনীয় পর্যায়ে উপনীত। টেলিভিশিন, পত্রপত্রিকা কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে যারা প্রতিদিন দৃষ্টি রাখেন, তারা এই দাবির সঙ্গে দ্বিমত করতে পারবেন না। গণপিটুনি বা ‘মব কালচার’ দেশ থেকে বিদায় নিয়েছেÑএমন কথা বলার সময় এখনো আসেনি। উপরন্তু, হররোজ কোনো না কোনো এলাকায় রাজনৈতিক হামলা—সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা ঘটছেই, উদ্ধার হচ্ছে ‘অজ্ঞাত লাশ’। স্বভাবতই এ সকল ঘটনার বিরূপ প্রভাব পড়ছে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সরকারের নিকট জনগণ সর্বদা ভয়ভীতিহীন পরিবেশে মুক্তভাবে চলাচলের গ্যারান্টি চায়, যা ‘মানকনিরাপত্তা’ নামে অভিহিত। ব্যক্তি—নিরাপত্তার এই ধারণা খোদ জাতিসংঘ কতৃর্ক স্বীকৃত। ব্যক্তি—নিরাপত্তার সহজ অর্থ হলো, রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। প্রতিটি কল্যাণ রাষ্ট্র তার নাগরিকদের এই নিরাপত্তা প্রদান করে থাকে। কিন্তু বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায়শই ব্যক্তিনিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ভূলুণ্ঠিত হতে দেখা যায়। জাতিসংঘ কর্তৃক ব্যক্তি বা মানব নিরাপত্তা ঘোষণায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘ People have the right to live, freedom and dignity. Free from poverty, and despair… with an equal opportunity to enjoy all their rights and fully develop their human potential. ’ কিন্তু বাস্তব জীবনে আমরা এই কথার প্রতিফলন খুব একটা প্রত্যক্ষ করি বলে মনে হয়না!
বিশেষভাবে লক্ষণীয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন চাঁদাবাজি, লুটপাটের একাধিক ঘটনা ঘটছে। দুষ্কৃতিকারীদের হাতে বাসাবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা জমিজমা বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এই সংস্কৃতির ফলে কেবল ব্যক্তিগত নিরাপত্তাই বিঘ্নিত হচ্ছে না, বরং এটা সামাজিক সন্ত্রাস ও মাস্তানতন্ত্রের পথকেও সুগম করে তুলছে। মানব নিরাপত্তার প্রশ্নে এটা মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। মানুষ যদি একাকী—নির্ভয়ে চলাফেরা করতে না পারে, ব্যবসায়—বাণিজ্যের পরিবেশ ভীতিমুক্ত করা না যায়, তাহলে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্রমবর্ধমানভাবে আরো সংকুচিত হতে থাকবে।
শাসন ক্ষমতার পরিবর্তনের পর দেশে অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করা অস্বাভাবিক নয়। তবে কত দ্রুত সেই ক্রান্তিকালের উত্তরণ ঘটানো যায়, তাই আসল কথা। কারণ, ক্ষমতার পালাবদলের পর অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দুষ্টের লালন করতে দেখা যায়। সেরূপ অবস্থায় শিষ্টের দমন অবধারিত ও ত্বরাণ্বিত হয়ে ওঠে। সম্মান ও মর্যাদার সহিত মানুষ বসবাস করতে পারে না। দায়িত্ব পালনের প্রশ্নে অসুবিধায় পড়ে যায় দেশের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর ফলে স্বভাবতই সুশাসনের পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়র উপক্রম হয়। ফলে সেই সমাজে ব্যক্তি—নিরাপত্তার আশা করা হয়ে ওঠে কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার আকাশে চাঁদ দেখার আশা করার মতো বিলাসি চিন্তার মতো।
আমাদের দেশে প্রায় সকল ক্ষেত্রের নিরাপত্তা পুলিশ বাহিনীকে সামাল দিতে হয়। তবে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর চলমান বাস্তবতায় পুলিশ বাহিনীর পক্ষে সব দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়ে উঠছে না বলে প্রতীয়মান। সেনাবাহিনী অবিরত কাজ করে যাচ্ছে বটে। তবে রাতরাতি অবস্থার উত্তরণ ঘটবে না! রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, ‘সর্বাধিক মানুষের জন্য সর্বাধিক সুখ’ (Greatest happiness to the highest number of people) নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। তবে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করর দায়িত্ব সরকারের হলেও সমাজ যতক্ষণ না সচেতন হবে, ব্যক্তিনিরাপত্তার পূর্ণ নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং, সকলকে সজাগ, সতর্ক থাকতে হবে। চলমান বাস্তবতায় দেশের দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদগণ জাতীয় নিরাপত্তা সুদৃঢ় করার বিষয়কে এক নম্বর প্রায়োরিটি হিসেবে দেখবেন বলেই আমরা মনে করি।