আজ আমরা স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে কিছু জানব। তত্কালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় তার জন্ম, বনেদি এক সচ্ছল পরিবারে। তার মা ভুবনেশ্বরী, বাবা বিশ্বনাথ দত্ত। বিবেকানন্দ মা-বাবার ৯ সন্তানের মধ্যে পঞ্চম, পুত্রদের মধ্যে প্রথম। ছোটবেলায় তার নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ।
তার জীবন ও কর্ম আমাদের অযুত শিক্ষা দেয়। ছোটবেলায় অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বড় হন তিনি। বাবা ছিলেন অ্যাটর্নি ও বহু অর্থ রোজগার করে বিরাট পরিবারটিকে ভোগবিলাসের মধ্যেই রেখেছিলেন। মা সে আমলে মেমসাহেবের কাছে ইংরেজি শেখেন, যার ফলে নরেন্দ্রনাথের সে ভাষা শেখানোর গুরু তার মা!
বিবেকানন্দের জীবন নানাভাবে তার পরিবারের দ্বারা প্রভাবিত। তার লেখকসত্তার পেছনে পিতা বিশ্বনাথের ভূমিকা ছিল, তিনি লেখালেখি করতেন। এমনকি তাকে ঔপন্যাসিক রূপেও পাই আমরা। ‘সুলোচনা’ বিশ্বনাথের লেখা একটি পারিবারিক উপন্যাস। এই উপন্যাসেই তিনি স্বরচিত কয়েকটি গানেরও সমাবেশ ঘটান। উল্লেখ্য, বিবেকানন্দ কেবল যে ভালো গান জানতেন তা-ই নয়, ‘সংগীতকল্পতরু’ নামে একটি বৃহত্ আকারের বাংলা গানের সঙ্কলন সম্পাদনা করেছিলেন তিনি, মাত্র ২৪ বছর বয়সে। নিজে গান লিখেছেনও।
বিবেকানন্দের ঠাকুরদা দুর্গাপ্রসাদ দত্ত সন্ন্যাস নিয়েছিলেন, যখন তার পুত্র বিশ্বনাথ মাত্র ছ-বছরের।
লেখালেখি করতেন এমনকি বিবেকানন্দের পিতামহী শ্যামাসুন্দরীও। ‘গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিনী’ তার রচিত গ্রন্থ। বিবেকানন্দের দুই সহোদর মহেন্দ্রনাথ (১.৮.১৮৬৮-১৪.১০.১৯৫৬) ও ভূপেন্দ্রনাথ (৪.৯.১৮৮০-২৫.১২.১৯৬১)-ও গ্রন্থকার ছিলেন।
বিবেকানন্দের বাল্যজীবন আর পাঁচটা বালকের মতোই কেটেছিল। দুরন্ত ছিলেন খুব, আর পড়াশোনায় মেধাবী। পড়ালেখার সঙ্গে খেলাধুলা ও সংগীতের চর্চা চলত। পিতার কর্মসূত্রে তার সঙ্গে ১৮৭৭-৭৮-এ ছত্তিসগড়ের রায়পুরে কাটান। পরে কলকাতায় ফেরেন। কলেজে পড়াকালীন তিনি পাশ্চাত্য মনীষীদের লেখার সঙ্গে পরিচিত হন। বিএ পাশ করা পর্যন্ত তার জীবন ছিল একান্তই সুখের। এ সময় তিনি নিজস্ব পড়াশোনার পাশাপাশি পাশ্চাত্য লেখকদের রচনার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকেন। এদের মধ্যে ছিলেন ডেভিড হিউম, হেগেল, আউগুস্ত কোঁত, জন স্টুয়ার্ট মিল, শোপেনহাওয়ার ও ডারউইন। হার্বার্ট স্পেনসারের সঙ্গে তার পত্রবিনিময় হতো। তিনি স্পেনসারের ‘Education’ বইটির বঙ্গানুবাদ-ও করেছিলেন। প্রেসিডেন্সি ও জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে (অধুনা স্কটিশচার্চ কলেজ) তার পড়াশোনা। সঙ্গে ব্রাহ্মধর্মে আগ্রহী। কেশবচন্দ্র সেনের নববিধান দলের সদস্য। ‘Band of Hooe’ নামে কেশবচন্দ্রের একটি ধূমপান ও মদ্যপানবিরোধী সংগঠনের সদস্য। নিরাকারে ঘোর বিশ্বাসী।
কিন্তু ১৮৮৪-তে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ডায়াবেটিস ও হার্টের সমস্যায় পিতা বিশ্বনাথ দত্তের মৃত্যুতে যে পারিবারিক দুর্যোগ নেমে আসে, তা কল্পনাতীত। সেই প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে তিনি পরবর্তী মাত্র ১৮ বছরে যা দিয়ে গেলেন আমাদের এবং একই সঙ্গে বিশ্ববাসীকে, তা ভাবলে বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এ সময়েই শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তার পরিচয়, যদিও প্রাথমিক সাক্ষাত্ ঘটেছিল ১৮৮১-তে, সুরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িতে।
তিনি পদব্রজে সমগ্র ভারত ঘুরেছেন, দেশের মানুষকে চিনতেন গভীর ও নিবিড় করে, জাতপাতের সংস্কার মানতেব না কদাপি। শূদ্র, অর্থাত্ নিম্নবর্গের জাগরণের কথা বলে গেছেন, আর বলেছেন, মানুষের মধ্যে আছে অপার শক্তি ও সম্ভাবনা। মুসলিম সমাজ ও ইসলামের প্রতি তিনি ছিলেন অগাধ শ্রদ্ধাশীল। নারীশক্তির জাগরণ চেয়েছিলেন তিনি।
বিবেকানন্দের কাছ থেকে শিক্ষণীয় কী? সত্যকে ভালোবাসা, সর্বার্থে সত্যনিষ্ঠ হওয়া। তিনি বলেছেন, ‘সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কোনো কিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না’। এমন এক পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি, যেখানে বিত্তবৈভবের মুহূর্তে অবসান ঘটে নিমেষে নেমে এসেছিল চূড়ান্ত দারিদ্র্য, দুবেলা আহার জোটেনি পরিবারে। তার দুই বোন আত্মহত্যা করেন, এক বোন অকালে মারা যান। এত সব বিপর্যয়ের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে তিনি আমেরিকায় গেলেন বিশ্বধর্ম মহাসভায় যোগ দিতে এবং সমস্ত ভিন্নপন্থি মানুষের মন জয় করলেন, চার বছরের মতো কাটালেন আমেরিকা এবং ইউরোপে। হার্ভার্ড এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অধ্যাপনা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে তার পরিব্রাজক জীবন ও নিজ উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে বলে ঐ লোভনীয় পদ তিনি ত্যাগ করেন। লিখলেন প্রচুর, ঘুরলেন প্রচুরতর, বক্তৃৃতা দিলেন অসংখ্য, ‘উদ্বোধন’—নামে এক মাসিক পত্রিকার জন্ম দিলেন, যা ১২৭ বছর পার করে আজও চলছে! বাংলা ভাষার সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী পত্রিকা এটি। আরো একটি পত্রিকা তার উদ্যোগে প্রকাশিত হতে থাকে, ইংরেজিতে। নাম ‘Brahmabadin’ সেটিও চলছে। ‘শ্রীরামকৃষ্ণের মতাদর্শ ও বাণী প্রচারের জন্য বেলুড়ে গড়ে তুললেন একটি কেন্দ্র, যার শাখা বিশ্ব জুড়ে আজ দুশোর ওপর। বেলুড়ে আজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। আমেরিকায় যেখানে বিশ্বধর্ম সম্মেলন হয়েছিল, তার পাশের রাস্তাটির নাম তার নামে নামাঙ্কিত। নিউ ইয়র্কে বেদান্ত সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৯৪-তে।
মাত্র ৩৯ বছরের জীবন ছিল তার। এর মধ্যেই তার রচনাবলি দশ খণ্ডে, এত কর্মযজ্ঞের পরেও, ভাবা যায়? দু দুবার আমেরিকা ও ইউরোপ সফর করেছেন, মিশেছেন ম্যাক্স মূলার, ভারততত্ত্ববিদ পল ডিউসেন, ভগিনী নিবেদিতা, রোমা রোলাঁ প্রমুখ মনীষীর সঙ্গে। পরবর্তীকালে তার দ্বারা প্রভাবিত হন গান্ধী, বিপিনচন্দ্র পাল, বালগঙ্গাধর তিলক, নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু প্রমুখ।
বিদ্যাসাগর-প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে শিক্ষক হিসেবে বহিষ্কার করা হয়েছিল যাকে, সেই বিবেকানন্দ সম্পর্কে বিশ্বধর্ম সম্মেলনের প্রতিনিধিদের দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে চিঠিতে জানাচ্ছেন হার্ভার্ডের অধ্যাপক জন হেনরি রাইট,’ আমাদের সব অধ্যাপক একত্রে যতটা শিক্ষিত, ইনি তাঁদের চেয়েও বেশি শিক্ষিত।’ ভাবা যায়!
ধর্ম সম্মেলনে বলতে উঠে যখন গোড়াতেই তিনি ‘আমার আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ’ বলে উঠলেন, ৭ হাজার দর্শক অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে দুমিনিট ধরে করতালি দিয়েছিলেন। তার বক্তৃতার শেষে সেদিনের সভাপতি বারোজ বলেছিলেন, ‘কমলা-সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মসমূহের মাতা ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং তার শ্রোতাদের ওপর সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রভাব বিস্তার করেছেন।’ আমেরিকান প্রেস তো লিখেই ফেলল, ‘ভারতের সাইক্লোন সন্ন্যাসী’! অন্যদিকে New York Herald:’ তার বক্তৃতা শুনে আমরা অনুভব করি এ শিক্ষিত জাতির কাছে মিশনারি পাঠানোটা কী প্রকার বোকামি!’
কেবল নিজের দেশটাকেই নয়, সারা পৃথিবীকে জাগাতে চেয়েছিলেন তিনি। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার ক্ষুদ্রতায় ব্যথিত হয়ে লিখেছেন, ‘ত্রিশ টাকার কেরানির চাকরির জন্য সমস্ত আত্মা অবনত, অথবা একজন উকিল হওয়া-নবীন ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষার শিখর-আর প্রত্যেক ছাত্রের সঙ্গ তার পায়ে পায়ে ঘুরে একদল ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়ের রুটি চাচ্ছো। তোমাদের বইগুলোর, গাউনের, বিশ্ববিদ্যালয় ডিপ্লোমাগুলোর আর সবকিছু ডোবার জন্য সমুদ্রে যথেষ্ট জল কি নেই? কী জাগৃতিবহ-ই না ছিল তার উচ্চারণ : I am He! I am Absolute!’
পিতা ও ভ্রাতাদের মতোই বেশ কয়েকটি ভাষা জানতেন। তার এক ভাই মহেন্দ্রনাথ ৮৮ বছর বাঁচেন, পদব্রজে ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকা ঘোরেন পাঁচ বছর ধরে। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, স্থাপত্য, জীববিজ্ঞান, শ্রীরামকৃষ্ণ ও তার পার্ষদদের জীবনী ইত্যাদি বিষয়ে প্রায় ৯০টির মতো বই লেখেন। অপর ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (৪.৯.১৮৮০- ২৫.১২.১৯৬১) বেঁচেছিলেন ৮১ বছর। ছিলেন স্বাধীনতাসংগ্রামী,! যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক, অরবিন্দ-শিষ্য। জেল খেটেছেন। পরে সুদূর ক্যালিফোর্নিয়া গিয়ে গদর পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২১-এ মস্কো আসেন, দেখা করেন লেনিনের সঙ্গে। তার সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা নিয়েও মতবিনিময় হয়।
অতএব কেবল বিবেকানন্দ নন, তার দুই ভাই মিলে এক বহ্নিময়তার দ্যুতি! যেন ভুলে না যাই।
আলস্য আর বিলাসী জীবনকে ঘৃণা করতেন তিনি। স্বামী অক্ষরানন্দকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘অলসভাবে বসে থেকে, রাজকীয় খাবার খেয়ে আর রামকৃষ্ণ, ও প্রভু! বলে ভালো কিছু হবে না’। আমাদের জন্য রেখে গেছেন এই অমোঘ বাণী, ‘ওঠো, জাগো এবং লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত থেমো না!’ বলেছেন, ‘দিনে অন্তত একবার নিজের সঙ্গে কথা বলো, নইলে তুমি একজন অসাধারণ মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত্ মিস করে করবে’। আর তার বাণীর সারাত্সার : ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর!’
‘ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছো বারেবারে/দয়াহীন সংসারে’,- রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির সার্থকতাই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম আর কর্মময়তার মধ্যে।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক