দেশের স্বাস্থ্য খাতে অনেক অর্জন সত্ত্বেও এই খাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কারণে জনগণ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতে চিকিত্সক ও নার্সের স্বল্পতা, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের মধ্যে নেতিবাচক মানসিকতা, চিকিত্সায় উচ্চব্যয় বহনে রোগীদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা, দেশের সর্বত্র উন্নতমানের ওষুধের ও চিকিত্সাসেবার ঘাটতি এবং প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে চিকিত্সার উচ্চ ব্যয়, এই খাতে সমস্যাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
একটি ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে আমরা সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকরী একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। এই খাতে সংস্কার শুধু প্রয়োজনীয় নয়, এটা আমাদের জন্য একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতারও বিষয়। এই বিষয়গুলো সমাধান করার জন্য আমাদেরকে একটি ব্যাপক ও বহুমাত্রিক ব্যবস্থার পথ অবলম্বন করতে হবে।
বর্তমানে দেশে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশন কাজ করছে, তাদের কার্যক্রম এমন হতে হবে, যাতে এলোপ্যাথির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী চিকিত্সাপদ্ধতি আয়ুর্বেদ, ইঊনানি ও হোমিওপ্যাথি সমান গুরুত্ব পায়। দেশের সবার মানুষ, ভৌগোলিকভাবে তারা যেখানেই বসবাস করুক না কেন এবং তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা যা-ই হোক না কেন। এই লক্ষ্য অর্জনে সরকার, প্রাইভেট সেক্টর ও সিভিল সোসাইটিকে একযোগে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশিরা বিদেশে চিকিত্সার জন্য বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করেন। উন্নত চিকিত্সার জন্য বিদেশগামিতার এই প্রবণতা দেশের চিকিত্সাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও বিশেষায়িত চিকিত্সার অভাবের দিকটি স্পষ্ট করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। গভর্নরের এই বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে।
এসডিজির লক্ষ্য নম্বর ৩ (সুস্বাস্থ্য এবং কল্যাণ) সবার জন্য সু্স্থ জীবন এবং কল্যাণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্বের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত রয়েছে। ব্যবধান দূর করতে এবং ন্যায়সংগত স্বাস্থ্যসেবার বিধান নিশ্চিত করতে উক্ত বৈষম্য মোকাবিলা করা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সবার জন্য স্বাস্থ্যের অভিন্ন লক্ষ্য এবং এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথ প্রশস্ত করার দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।
সবার জন্য স্বাস্থ্যকর জীবন নিশ্চিত করার সুবিধাগুলি এই খাতে কৃত খরচের চেয়ে বেশি সুবিধাজনক, কারণ সুস্থ মানুষই সুস্থ অর্থনীতির ভিত্তি। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য একটি মৌলিক প্রয়োজনীয়তা। দেশের জনগণকে রক্ষা করতে হবে যারা রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের বোঝা হয়ে থাকে। এটি করার জন্য আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্য হলো প্রত্যেকে যাতে আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন না হয়ে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে, তা নিশ্চিত করা। আমাদের জাতীয় সংবিধানও স্বাস্থ্য বিষয়টির প্রতি জোর দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্র জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সুতরাং, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য।
স্বল্প আয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বাস্থ্যসূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। কিন্তু নিরাময়মূলক যত্ন এর প্রাপ্তি এবং গুণমান এই উভয় বিষয়ে গুরুতর সমস্যা রয়েছে, যার কারণে দরিদ্ররা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। গ্রামীণ এলাকায় স্থানীয় পর্যায়ে সেবা প্রদানের অবকাঠামো বিদ্যমান রয়েছে, কিন্তু সেগুলো অদক্ষভাবে কাজ করে।
দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ রোগীদের মানসম্মত চিকিত্সা নিশ্চিত করতে পারে। এটা প্রশংসনীয় যে, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, কিন্তু মানুষ এখনো ডাক্তার, ওষুধ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা তৃণমূল পর্যায়ে যেমন উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে খুঁজে পায় না। এখনো চিকিত্সা নিতে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে অনেক লোকজনকে ছুটতে দেখা যায়।
কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলাহীনতা সৃষ্টি করেছে। অনেক হাসপাতাল সেবা প্রদানের জন্য সংগ্রাম করছে, অন্যদিকে অন্যরা খুব কম রোগী পাচ্ছে। ডাক্তার, ওষুধ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে খুব কমই পাওয়া যায়।
নগর এলাকায় কেন্দ্রীভূত উন্নয়ন মানুষকে উন্নত জীবনযাপনের জন্য শহরে স্থানান্তরিত করতে আকৃষ্ট করে এবং ফলস্বরূপ অনেক আর্থসামাজিক এবং পরিবেশগত সমস্যার দিকে নিয়ে যায়। অধিকন্তু, উচ্চ ঘনত্বের শহুরে জীবনযাত্রার ইঞ্জিনগুলি সংক্রামক রোগের দ্রুত বিস্তার ঘটায় এবং এর ফলে লাখ লাখ মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়ে।
অভিবাসীদের দ্রুত আগমন এবং বড় শহরগুলিতে শহুরে বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি শহুরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা (পিএইচসি) এর ওপর ক্রমাগত চাপ তৈরি করছে। মৌলিক পরিষেবা প্রদানের দৃষ্টিকোণ থেকে এই অভিবাসীদের থাকার জন্য শহরগুলি সুসজ্জিত নয়। দরিদ্র আবাসন, অনিরাপদ জল সরবরাহ, দুর্বল পরিবেশগত স্বাস্থ্য পরিষেবা, দুর্বল স্যানিটেশন, জনাকীর্ণ জীবনযাত্রার অবস্থা, এবং সাশ্রয়ী মূল্যের পিএইচসি পরিষেবার অভাবের ফলে শহুরে দরিদ্রদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যসমস্যা এবং অপুষ্টির সমস্যা সৃষ্টি করছে।
স্বাস্থ্যসেবার ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা বিকেন্দ্রীকরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীভূত স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব না। শহুরে জনসংখ্যা, বিশেষ করে শহুরে দরিদ্রদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা (পিএইচসি)সহ শহুরে জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির কভারেজ এবং গুণমান উভয় ক্ষেত্রেই সম্প্রসারণের প্রয়োজন রয়েছে। রোগ-ব্যাধির মূল কারণকে মোকাবিলা করার জন্য একটি ব্যাপক এবং সু-সমন্বিত বহুমাত্রিক পদ্ধতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
শহুরে স্বাস্থ্যসমস্যার জটিল প্রকৃতির কারণে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের যৌথ পদক্ষেপ এবং একত্র প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। শহুরে পাবলিক হেলথ সেক্টর প্রোগ্রামগুলি ব্যাপক হওয়া উচিত, যাতে সব সরকারি, বেসরকারি, এনজিও, সম্প্রদায়ভিত্তিক সংস্থা, সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে।
দেশের প্রতিটি উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে, যেখানে মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী যথাযথ চিকিত্সাসুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই গ্রামাঞ্চলের মানুষ চিকিত্সার জন্য ঢাকায় আসতে বাধ্য হচ্ছে, এর ফলে রাজধানীর হাসপাতালগুলোর ওপর রোগীদের বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে এমনভাবে সম্প্রসারণ করতে হবে, যাতে উপজেলার মানুষদের চিকিত্সার জন্য তাদের উপজেলার বাইরে আসতে না হয়। তাই উপজেলাভিত্তিক হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা জোরদার করা প্রয়োজন।
উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে কোনো গুরুতর রোগীকে যথাযথ চিকিত্সা দেওয়া সম্ভব না হলে এ ধরনের রোগীকে ঢাকায় রেফার করার জন্য রেফারেল সিস্টেম তৈরি করতে হবে। গর্ভবতী মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীদের অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালের জরুরি ইউনিটে বিনা মূল্যে পরিবহন করা প্রয়োজন। কারণ, সরকারি যানবাহনে জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন ও স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা নেই।
আমরা যদি গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে চাই, তাহলে স্বাস্থ্য খাতের সব পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে উপজেলা পর্যায়ে চিকিত্সক, টেকনিশিয়ান, নার্সের উপস্থিতি এবং প্রয়োজনীয় চিকিত্সাসরঞ্জামের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে, যে কোনো ধরনের অনিয়ম হলে কঠোর হস্তে মোকাবিলা করতে হবে। জনগণকে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের স্বার্থে জেলা পর্যায়ের সব অযোগ্য হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রধান ডা. এ কে আজাদ খান সথার্থই বলেছেন, ‘ওষুধ কোম্পানি থেকে ডাক্তারদের কমিশন নেওয়া অনৈতিক ও অবৈধ’। ওষুধের দাম স্থিতিশীল রাখতে বাজার মনিটরিং করা জরুরি। সব জেলায় সিভিল সার্জন অফিস রয়েছে। সিভিল সার্জনদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা দেশের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় বলে অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টির প্রতি জরুরি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
রোগীদের বিদেশযাত্রা ঠেকাতে স্বাস্থ্য শিক্ষার ওপর জোর ও স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাড়ানোসহ জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলো যেন পরীক্ষা ও ওষুধের দাম বেশি রাখতে না পারে, সেটি নিয়েও কাজ করতে হবে। স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের মাধ্যমে রোগীবান্ধব হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা শুধু ক্লিনিকাল কেয়ারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর মধ্যে আরো রয়েছে নিরাপদ পানীয় জলের সুবিধা, কঠিন বর্জ্য নিষ্পত্তি, পরিবেশদূষণ প্রতিরোধ এবং শহরাঞ্চলে নিরাপদ খাদ্যের সহজপ্রাপ্যতা। স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই এ ব্যাপারে কোনো ধরনের অবহেলা গ্রহণযোগ্য নয়।
লেখক : পাবলিক হেল্থ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ-এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক
(এই লেখার সম্পূর্ণ দায়ভার লেখকের নিজের; দৈনিক মূলধারা এটি জনসমক্ষে তুলে ধরছে মাত্র । এর সঙ্গে দৈনিক মূলধারা কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। ফলে এ-সংক্রান্ত কোনো দায়-দায়িত্ব মূলধারা বা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত কেউই বহন করবে না।)