একটি বহুল প্রচলিত কথা আছে—ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে দেয় এবং বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ হয়। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে আমরা এর প্রমাণ পাই। ক্ষমতার উত্তাপ এতটাই বিস্ময়মধুর যে, এটা ক্ষমতাসীনদের মস্তিষ্কে একটি সূক্ষ্ম এবং দৃঢ় পর্দা তৈরি করে দেয়। আর সেই পর্দার ফিল্টারে আটকা পড়ে যায় ‘মাঠের সত্য’। অন্যদিকে, ক্ষমতার উত্তাপে মস্তিষ্কে যেই ঘোর তৈরি হয়, তাতে যুগে যুগে সকলেই ‘বড় বড় কথা’ বলে থাকেন। অবশ্য তৃতীয় বিশ্বেই এমনটা বেশি দেখা যায়। এমনিতেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অনিশ্চয়তার শেষ থাকে না। এই অনিশ্চয়তা অনেকটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে বসবাস করার মতো। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির জীবন্ত হতে সময় লাগে না। অতঃপর সেই আগ্নেয়গিরি হতে প্রবহমান লাভা-স্রোতে ভেসে যায় চারপাশ। ইংরেজি প্রবাদের মতো অবস্থাটি হলো—‘সিটিং ওন আ লাইন ভলকানো’।
সুতরাং প্রশ্ন উঠতে পারে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যিনি বা যারা ক্ষমতার উত্তাপে অতীতে বড় বড় কথা বলেছেন—তারা কি কখনো চক্ষু মুদিয়া ধ্যানস্থ হয়ে অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য ভেবে দেখেছিলেন—তিনি বা তারা আসলে কীসের ওপর আসীন রয়েছেন? তার বা তাদের খুঁটির জোর ঠিক কোথায় এবং তা কতটা শক্তিশালী? তারা বা তিনি ভেবে দেখেছেন কখনো—‘আমি কি শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে আছি? মাটি কি আছে পায়ের তলায়? নাকি তা একটি তপ্ত আগ্নেয়গিরি? যে কোনো সময় লাভার উদিগরণ ঘটতে পারে!’
মনে রাখতে হবে, একটি অপূর্ব সুশৃঙ্খলা বজায় রয়েছে সমগ্র মহাবিশ্বে। বিস্ময়কর ভারসাম্য বজায় রয়েছে এই সুন্দর জগত্ জুড়ে! মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা, আত্মমর্যাদাবোধ দিয়ে। আর তার পর সতর্ক করেছেন বাড়াবাড়ি না করতে; কিন্তু যারা বাড়াবাড়ি করেন, তারা ভুলে যান, প্রকৃতি চিরকাল একই রকম থাকে না। বিজ্ঞান বলে, কোনো স্থানে বাতাস খুবই গরম হয়ে গেলে তা ঠান্ডা করতে ঝড় সৃষ্টি হয়। একইভাবে, প্রতিনিয়ত গরমের দাপট বাড়তে থাকলে সাগরের বুকে সৃষ্টি হয় নিম্নচাপ। আর এর চেয়েও বেশি বাড়াবাড়ি হলে সেই নিম্নচাপ থেকে ভয়ানক ঝড় এসে লন্ডভন্ড করে দেয় সবকিছু। বিশ্বব্যাপী সমাজ-রাষ্ট্রে এটার-ই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও আমরা কেন বাড়াবাড়ি করতে ভয় পাই না? প্রকৃতপক্ষে যারা যথার্থ জ্ঞানী, তারা নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি করতে ভয় পান। অন্যদিকে, যারা অপরিণামদর্শী, তারাই কেবল সীমা লঙ্ঘনের বিপদ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন। তৃতীয় বিশ্বের যারা ক্ষমতার ওমে থাকেন—তাদের মূল শক্তি হলো পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ। এর বাইরে তাদের আর কি কোনো শক্তি থাকে? এই ক্ষমতার ওম চলে গেলেই তারা শূন্যগর্ভে তলিয়ে যান। এই যখন অবস্থা, তখন বড় বড় কথা বলাটা কি নির্বুদ্ধিতা নয়?
অনেকেই বলেন সংগঠনের কথা; কিন্তু সংগঠনের মধ্যে যদি কোনো আদর্শ না থাকে, তখন সেই সংগঠনের কোনো নৈতিকতা থাকে না। অথচ সংগঠনের কুশীলবরা যেই সকল অপরাধ-অপকর্ম করেন, দিনের শেষে তার দায় শীর্ষ মহলের উপরই বর্তায়। অতঃপর উত্তাপ জমে-জমে যখন লাভা-স্রোতের ঢল নামে কিংবা প্রবল ঝড় উঠে সব কিছু উড়িয়ে-ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তখন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মনের গহিনে কেবল গুঞ্জরিত হয় হেমন্তের সেই গান—‘আমার জীবনের এত খুশি এত হাসি কোথায় গেল?’ দেখা যায়, এই ধরনের সংগঠন বহুলাংশে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো! অর্থাৎ, দেখতে সুন্দর, খেতে সুন্দর, কিন্তু বাস্তবে খুব একটা কাজে লাগে না।
এখন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যিনি বা যারা দেশের উপকার করতে চান—তাদের ভাবতে হবে—স্বাধীনতার পূর্বের রাজনীতি আর স্বাধীনতার পরের রাজনীতি এক নয়। একজন রাজনীতিক এই ব্যাপারে একসময় বলেছিলেন—“স্বাধীনতার পূর্বের রাজনীতি ছিল ‘ভাঙার’, আর স্বাধীনতার পরের রাজনীতি হলো ‘গড়ার’। আর গড়তে হলে যা লাগে, তা হলো ঐক্য। অনেক বিষয়ে অনেক কিছুতেই মতের অমিল থাকবে নিশ্চয়ই; কিন্তু দেশ গড়ার ক্ষেত্রে ঐক্য থাকতেই হবে।” বস্তুত, এখানে সবাই এসে কানাগলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে! এই অনৈক্যের কানাগলি হতে জাতিকে বের হয়ে আসতে হবে।